রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎসে কর প্রস্তাবের চেয়ে কমিয়ে এবং মোবাইল ফোনের বিলের ওপর উৎসে কর কাটার প্রস্তাব প্রত্যাহার করে অর্থমন্ত্রী উপস্থাপিত অর্থ বিল বুধবার জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে।
এই বিল পাসের ফলে ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ২ লাখ টাকা হলো।
বিভিন্ন খাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগও থাকছে। অর্থ্যাৎ যে কোনো খাতে কালো টাকা সাদা করা যাবে।
স্পিকার আবদুল হামিদের সভাপতিত্বে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত অর্থ বিল-২০১২ বুধবার রাত ৯টা ৫ মিনিটে সংসদে উত্থাপন করেন। বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে ৯টা ৫৮ মিনিটে কণ্ঠভোটে তা পাস হয়।
বিল পাসের সময় প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা সংসদে ছিলেন। বিল পাসের আগে বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে রপ্তানি পণ্যে উৎসে কর কাটার হার কমাতে বলেন তিনি।
ব্যক্তি শ্রেণীর করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো এবং মোবাইল ফোনের বিলের ক্ষেত্রে উৎসে কর প্রত্যাহার করতেও বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ শোনার পর অর্থমন্ত্রী বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর যে কোনো অনুরোধ আমি নির্দেশ বলে মনে করি। এখানেও ব্যত্যয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
পাস হওয়া বিলে মোবাইল ফোনের বিলের ওপর ২ শতাংশ উৎসে কর কাটার প্রস্তাব আর নেই। সব ধরনের রপ্তানি পণ্যে উৎসে কর কাটার হার ১ দশমিক ২ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশ নামিয়ে আনা হয়েছে। মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও শুল্ক বিষয়ে বেশ কিছু সংশোধনও এসেছে।
এই বিলের ওপর আনা জনমত যাচাই প্রস্তাবগুলো নাকচ হয়। তবে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনী গ্রহণ করা হয়।
বিলটির উদ্দেশ্য ও কারণ সম্বলিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এই অর্থ বিলের উদ্দেশ্য হলো ২০১২ সালের ১ জুলাই থেকে শুরু হতে যাওয়া অর্থবছরের জন্য আর্থিক বিধান করা এবং কতিপয় আইন সংশোধন করা।
গত ৭ জুন ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবের দিন এই অর্থ বিল সংসদে উত্থাপন করেন মুহিত। ওইদিন তিনি ২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার বাজেট উপস্থাপন করেন। বাজেট প্রস্তাবের সময়ও বিএনপির সংসদ সদস্যরা সংসদে ছিলেন না।
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে অর্থমন্ত্রী ব্যক্তি শ্রেণীর করদাতাদের করমুক্ত আয়ের সীমা ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা করার প্রস্তাব করেন।
একইসঙ্গে মহিলা ও বয়স্কদের করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ২৫ হাজার টাকা এবং প্রতিবন্ধীদের করমুক্ত সীমা ২ লাখ ৭৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করেন।
সংশোধনীতে অর্থমন্ত্রী ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর (জরিমানা) দিয়ে বিভিন্ন খাতে কালো টাকা (অপ্রদর্শিত আয়) বিনিয়োগের সুযোগ দেন অর্থমন্ত্রী।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “অর্থ বিলে অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ১০ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ দিচ্ছি।”
মোবাইল ফোনের বিলের ওপর ২ শতাংশ উৎসে কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এই কর প্রস্তাবের পর বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা আসছিল।
সব ধরনের রপ্তানি পণ্যের উৎসে কর ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৮০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। ব্যবসায়ী মহল থেকে এই কর কমানোর দাবি জানানো হচ্ছিল।
কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবের সময় যুক্তি দেখিয়েছিলেন- “রপ্তাণি বাণিজ্য থেকে কিন্তু কর আদায় করাও দেশের স্বার্থে দরকার।”
বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাত থেকে শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্য রপ্তানি থেকে শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ হারে উৎসে কর কাটার বিধান ছিল।
এই অর্থবিল পাস হওয়ায় প্রস্তাবের চেয়ে কমলেও তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উৎসে কর বর্তমানের চেয়ে শূন্য দশমিক ১০ শতাংশ এবং অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ বেড়েছে।
কর সনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেই এমন আমানতকারীদের ব্যাংকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জমা টাকা থেকে কোনো কর কাটা হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
প্রস্তাবিত বাজেটে টিআইএন নেই এমন গ্রাহকদের আমানতের সুদ থেকে ১৫ শতাংংশ হারে উৎসে কর কাটার প্রস্তাব করেছিলেন মুহিত।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে করমুক্ত সীমা ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়ানোর সংশোধনী এনেছেন অর্থমন্ত্রী। ছোটো ব্যবসায়ীদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে ভ্যাট আদায়ের ক্ষেত্রে ৭০ লাখ টাকা পর্যন্ত ‘প্যাকেজ ব্যবস্থা’ বহাল রাখার সংশোধনী এনেছেন তিনি। এছাড়া অ্যালুমিনিয়ামের ওপর কর অব্যাহতি দেওয়ার ঘোষণা দেন মুহিত।
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে অর্থমন্ত্রী ২২ ইঞ্চি পর্যন্ত কম্পিউটার মনিটর আমদানি করমুক্ত রাখার সংশোধন এনেছেন। বিদায়ী বাজেটে ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত মনিটর আমদানি করমুক্ত ছিল।
জীবন বীমা গ্রাহকদের মেয়াদ শেষে মুনাফা থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটার যে প্রস্তাব করা হয়েছিল, তা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
ঢেউটিন তৈরির কাঁচামাল সিআর কয়েল আমদানির ওপর ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি প্রত্যাহার করে নিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটের ওপর প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রীসহ সবমিলিয়ে ২১৩ জন ৫০ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে সংসদে আলোচনা করেন।
অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমি দৃঢভাবে বিশ্বাস করি, বছর শেষে বিদায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। আর আগামী অর্থবছরে ৭ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তাও অর্জিত হবে।”
বক্তৃতায় নতুন বাজেটের ঝুঁকি ও সম্ভাবনার দিকগুলোও তুলে ধরেন মহাজোট সরকারের চতুর্থ বাজেট দেওয়া মুহিত।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশের মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি প্রবল। যে শক্তি দিয়ে আমরা যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলা করতে পারি। আশা করি, এই অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হব।”
“আর ঝুঁকি হচ্ছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। আর আশার কথা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমছে। ১৪০ ডলারের তেল এখন ১০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে,” বলেন মুহিত।