ঢাকা : একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠনের দুই বছর পর বিচার শুরু হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর তখনকার প্রধান গোলাম আযমের, বাঙালি হত্যায় পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তাকারী হিসেবে যার নামই সবার ওপরে উঠে আসে।
আগামী ৫ জুন তার বিরুদ্ধে তার ‘ওপেনিং স্টেটন্টন্ট’ দেওয়ার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল-১।
রাষ্ট্রপক্ষের দেওয়া ৬২টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি অভিযোগের ভিত্তিতে এ অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
এর আগে রোববার সাড়ে ১০টায় গোলাম আযমকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে ট্রাইব্যুনাল-১-এ হাজির করা হয়।
উল্লেখ্য, গত ১১ জানুয়ারি গোলাম আযমকে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৬২টি অভিযোগে দীর্ঘ ৪০ বছর পর ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে তাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কারাগারে পাঠানোর পর চিকিৎসার জন্য তাকে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেলে। বর্তমানে তিনি সেখানে চিকিৎসাধীন।
অভিযোগ গঠনের আগে আদালত আসামির কাছে জানতে চান, তিনি দোষী না নির্দোষ?
জবাবে গোলাম আযম বলেন, “এত অল্প সময়ে এত অভিযোগের বিষয়ে কথা বলা যায় না। তবে আমি নিজেকে দোষী বলে মনে করি না।”
তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের যে তালিকা হয়েছিল- তাতে তার নাম ছিল না।
“আমার নাম ছিল দালালদের তালিকায়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার সে সময় সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। সেই হিসাবে আমি আগেই ক্ষমা পেয়ে গেছি,” বলেন তিনি।
৮৯ বছর বয়সি গোলাম আযম এরপর রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে শুরু করলে বিচারক তাকে থামিয়ে দেন।
তার আগে তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পেছনে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ‘রাজনৈতিক অভিসন্ধি’ রয়েছে।
“২০০১ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ কখনো জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধী বলেনি। এটা বলা শুরু করেছে ২০০১ সালের পরে,” বলেন তিনি।
এর কারণ হিসেবে ভোটের হিসাব দেখিয়ে গোলাম আযম বলেন, জামায়াতের সমর্থনের কারণেই বিএনপি তখন সরকার গঠন করতে পেরেছিল। যাতে বিরূপ হয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করার মিশনে নামে। আর যুদ্ধাপরাধের বিচার ওই তৎপরতারই অংশ।
নিজের নির্দোষিতা পক্ষে বলতে দাঁড়িয়ে একাত্তরে পাক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহচর গোলাম আযম আরো বলেন, “শেখ মুজিব কখনো পাকিস্তান ভাঙতে চাননি। বরং তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন।”
গোলাম আযমের এই বক্তব্যের বিরোধিতা করে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম উঠে দাঁড়ালে তাকে নিবৃত্ত করে ট্রাইব্যুনাল।
এরপর ট্রাইব্যুনাল প্রধান নিজামুল হক জামায়াত নেতাকে থামিয়ে বলেন, এভাবে তিনি বলে গেলে অন্যরাও সে সুযোগ চাইতে পারে।
এই বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করার জন্য জামায়াত নেতার পক্ষে অভিজ্ঞ কৌসুলি থাকার কথাও স্মরণ করিয়ে দেন বিচারপতি এ কে এম জহির আহমেদ।
ট্রাইব্যুনাল প্রধান বলেন, “আমরা এই মুহূর্তে আপনি দোষী কিংবা দোষী নন বলে রায় দিচ্ছি না। এগুলো এখনো অভিযোগ।”
ট্রাইব্যুনালের অন্য বিচারক আনোয়ারুল হক বলেন, এই মুহূর্তে দোষী কিংবা নির্দোষিতার কথা ছাড়া অন্য কিছু বলা আইন সমর্থন করে না।
এরপর বিচারপতি নিজামুল হক জামায়াত নেতাকে তার আসনে বসতে বলেন এবং অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন।
আদালতের আদেশে বলা হয়, “উত্থাপিত অভিযোগ শোনার পর এই অভিযোগের ভিত্তিতে আপনার বিরুদ্ধে এখন বিচার শুরু করার নির্দেশ দিচ্ছি।”
এর আগে বিচারপতি নিজামুল হক প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো পড়ে শোনান।
জামায়াতের ‘গুরু’ হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আমলে নিয়ে গত ১১ জানুয়ারি তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
ওই দিনই তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়; তারপর থেকে তিনি সেখানেই আছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুুদ্ধের সময় তার নেতৃত্বে নানা জায়গায় শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল শামস, পাইওনিয়ার ফোর্স, মুজাহিদ বাহিনী নামে পাকিস্তানপন্থী সংগঠন গঠন করা হয়।
এসব সংগঠনকে অস্ত্র সরবরাহ করা এবং এ বিষয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সুপারিশ করার দায়িত্বও তার ছিল বলে ঐতিহাসিক বিভিন্ন দলিলে তার প্রমাণ রয়েছে।
একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হামলা শুরুর পর খাজা খায়রুদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যের যে শান্তি কমিটি হয়, তার তদারকিতে গঠিত কমিটির ছয় জনের এক জন ছিলেন গোলাম আযম।
এছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রকাশ্যে তদবির চালান তিনি।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আযম ১৯৭১ থেকে ৭ বছর লন্ডনে অবস্থান করার পর ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বাংলাদেশে আসেন।
এরপর ১৯৯১ সালে পুনরায় জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব নেন তিনি। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত দলের আমিরের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।