বার্তা৭১ ডটকমঃশুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ভারতে আটক করা বাংলাদেশী অভিবাসীদের সন্তানদেরকেও আলাদা করে রাখা হচ্ছে বছরের পর বছর। এমন ঘটনা ঘটছে পাশের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেও। সেখানে আটক বাংলাদেশী অভিবাসীদের পাঠানো হয়েছে জেলে। অন্যদিকে তাদের সঙ্গে থাকা শিশুদেরকে রাখা হয় আশ্রয় কেন্দ্রে। এমন ঘটনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যখন তোলপাড় চলছে তখন এ খবর প্রকাশ করেছে অনলাইন স্ক্রোল ডট ইন।
এতে ‘নট জাস্ট দ্য ইউএস: ইন্ডিয়া হ্যাজ সেপারেটেড বাংলাদেশী চিলড্রেন ফ্রম দেয়ার প্যারেন্টস ফর ইয়ার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা লিখেছেন দেবার্শী ঘোষ। এতে তিনি লিখেছেন, ১০ ফুট উঁচু একটি দেয়ালে বিশাল আকৃতির একটি হার্ট আঁকা। দক্ষিণ কলকাতায় এই দেয়ালটির ওপরে কাঁটাতারের বেড়া। সবুজ ক্ষেত, আবর্জনাযুক্ত রাস্তাঘাট, ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি তার মাঝ থেকে একটিই শব্দ বেরিয়ে আসছে। তা হলো-হাসির শব্দ। শিশু মেয়েদের টিটকারির শব্দ। অলাভজনক একটি প্রতিষ্ঠান সংলাপ পরিচালিত একটি আশ্রয় কেন্দ্র এটি। নাম স্নেহা। এর বাসিন্দাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশী মেয়েরা। তাদেরকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া ভারতে প্রবেশ করার কারণে আটক করা হয়েছে। মেয়ে শিশুদের এখানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যতক্ষণ বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ তাদের পরিবারকে সনাক্ত না করে এবং তাদেরকে ফেরত না নেয় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা এখানেই থাকে।
তাদেরকে দেশে ফেরত পাঠানো একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। তবে এমন কিছু শিশু কন্যা রয়েছে যারা বলেছে, তাদের পিতামাতাকেও আটক করে আলাদা জেলে আটক রেখেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। যুক্তরাষ্ট্রে মেক্সিকো সীমান্তে এ বছর পরিবারের কাছ থেকে এভাবে আলাদা করা হয়েছে ২৩০০ শিশুকে। এ নিয়ে চারদিকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া, ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ভারতও একই নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এর ফলে বাংলাদেশী অসংখ্য পরিবারের সন্তানদেরকে আলাদা করা হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র বিষয়ক ১৯৪৬ সালের আইনের ১৪-এ ধারার অধীনে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়া কেউ ভারতে প্রবেশ করলে বা ভারতে অবস্থান করলে তাকে সর্বনিম্ন দুই বছর ও সর্বোচ্চ আট বছরের জেল দেয়ার বিধান আছে।
দেবার্শী ঘোষ আরো লিখেছেন, যখন অভিবাসী পরিবারকে আটক করা হয় তখন এ পরিবারের পিতামাতাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে বিচার বিভাগীয় হেফাজতে পাঠানো হয়। অন্যদিকে তাদের সঙ্গে থাকা ৬ বছরের ওপরে বয়সী শিশুদেরকে চাইল্ড ওয়েলফেয়ার কমিটি অ্যান্ড দ্য জুভেনিল জাস্টিস বোর্ডের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। তারপর তাদেরকে পিতামাতার কাছ থেকে আলাদা করে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই এ রকম ৮০ টি আশ্রয়কেন্দ্র আছে। সেখানে আলাদা করা মেয়ে শিশু ও ছেলে শিশুদের রাখা হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন অনেক ঘটনাকে প্রামাণ্য আকারে উপস্থাপন করেছেন মহানির্বাণ কলকাতা রিসার্চ গ্রুপের সুচরিতা সেনগুপ্তা। এতে ভাদুরিবালা নামে একজন নারীর কাহিনী তুলে ধরা হয়েছে।
বলা হয়েছে, ভাদুরিবালার বয়স যখন ৪০ বছর তখন তাকে আটক করে বেহরামপুর সেন্ট্রাল কারেকশনাল হোমে রাখা হয় সাত বছর। তিনি দাবি করেছেন, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশ ছেড়েছেন। একটি ছেলে ও একটি মেয়ে, যারা অনেক ছোট, তাদেরকে নিয়ে তিনি ভারতে প্রবেশ করেন। ওই সন্তান দুটিকে আলাদা করে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। সেখানেই বড় হয়ে উঠা পর্যন্ত থাকতে হবে তাদেরকে। জেলে থাকা অবস্থায় চার বছর ধরে ছেলে ও মেয়েকে দেখতে পান নি ভাদুরিবালা। অধিকারকর্মীরা বলছেন, এভাবে সন্তানদের আলাদা করে রাখার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কনভেনশনে স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলো লঙ্ঘন হচ্ছে।
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চের সাংগঠনিক সেক্রেটারি বিপ্লব মুখার্জি বলেছেন, ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব দ্য চাইল্ড (ইউএনসিআরসি)-এর একটি অংশ ভারত। এর অধীনে পরিবারের সদস্যদের আলাদা করা যায় না। কিন্তু এখানে আমরা (ভারত) তাই করছি।
ইউএনসিআরসি-এর ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, একটি শিশুকে শুধু তখনই তার পিতামাতার কাছ থেকে আলাদ করা যাবে যখন সেটা তার সর্বোত্তম স্বার্থে আসবে। সেটা হতে পারে যদি ওই শিশুটিকে তার পিতামাতা নির্যাতন করে বা অবহেলা করে। যখনই কোনো পিতামাতাকে কর্তৃপক্ষ আটক করে, জেলে দেয় বা নির্বাসনে পাঠায় তখন তাকে তার সন্তান কোথায় আছে তা অবশ্যই বিস্তারিতভাবে জানতে হবে।
তবে পশ্চিমবঙ্গ কর্তৃপক্ষ বলছে, সাবধানতার সঙ্গে পরিবারগুলো থেকে এই বিচ্ছিন্নকরণ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের শিশুর অধিকার সুরক্ষা বিষয়ক কমিশনের চেয়ারপারসন অনন্যা চক্রবর্তী বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের জেলগুলো খুবই মানবিক। ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রত্যক্ষ্য করেছি কিছু জেলার শিশুদেরকে তাদের মায়ের সঙ্গে থাকার অনুমতি দিয়েছেন। কারণ, মা ও শিশু আলাদা হতে চান নি। একই রকম কথা বলেছে স্নেহা।
এর তত্ত্বাবধায়ক মমতা চক্রবর্তী বলেছেন, যখন পিতামাতাকে জেলে রাখা হয় তখন আমরা তাদের সন্তানদেরকে তাদের সঙ্গে রাখি। কখনো কখনো তাদের পিতামাতাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তারপর তারা যথাযথ কাগজপত্র সহ এখানে আসেন তাদের সন্তানদের সঙ্গে সাক্ষাত করতে। পিতা ও মাতা জানেন তাদের সন্তান কোথায় আছে। তবে মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা বলছেন, এমন বক্তব্য বিরক্তিকর। শিশু সন্তানরা যখন ভারতের জেলে বন্দি থাকে তখন তাদের পিতামাতাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো একটি বিরক্তিকর বিষয়। সীমান্ত এলাকায় যেসব বাংলাদেশীকে আটক করা হয় তাদেরকে আইনি সহায়তা দেন সমাজকর্মী মহিদুল ইসলাম।
তিনি একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। বলেন, বাংলাদেশ হয়ে প্রায় ২০ জন রোহিঙ্গা মুসলিম প্রবেশ করেন পশ্চিমবঙ্গে। তাদেরকে দু’বছর আগে সীমান্তে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় একজন মাকে পররাষ্ট্র বিষয়ক আইনের ১৪-এ ধারার অধীনে অভিযুক্ত করে পাঠানো হয়েছে দমদম জেলে। কিন্তু তার ছেলে ও মেয়ে শিশু দু’টিকে পাঠানো হয়েছে আলাদা আশ্রয়কেন্দ্র। একবার যখন পিতামাতা ও সন্তানকে আলাদা করে ফেলা হয় তখন তাদের মামলাকে আলাদা হিসেবে দেখা হয়। আলাদা এসব মামলার শুনানি হয় আলাদা কোর্টে। মহিদুল ইসলাম বলেন, আমরা আদালতে এসব শুনানিতে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করি। এক্ষেত্রে মায়ের শুনানি হয় এক তারিখে।
সন্তানদের মামলার শুনানি হয় অন্য তারিখে। তারপর কয়েকদিন পরে শুনতে পাওয়া যায় যে, একটি শিশু মারা গেছে। মাঝে মধ্যে পিতামাতাকে প্রথমে ফেরত পাঠানো হয় তার দেশে। সম্প্রতি তাদেরকে ঝুঁকিপূর্ণ পুশব্যাক সিস্টেমে পাঠিয়ে দেয়া হয় বাংলাদেশে। তবে শিশুরা রয়ে যায় আশ্রয় কেন্দ্রে। উপরন্তু এমনও ঘটনা ঘটে, পাচারকারীরা নিজেদেরকে এসব শিশু কন্যার পিতামাতা দাবি করে বসে। তারা কর্তৃপক্ষকে ভুল তথ্য দিয়ে সন্তানদের নিয়ে নেয়।