বার্তা৭১ ডটকমঃ বিগত কয়েক সপ্তাহে ধর্ষণ বিরোধী যে গণজাগরণ তা বিগত দিনের এই সংক্রান্ত সব আন্দোলনকে পিছিয়ে দিয়েছে কি-না আমার সন্দেহ আছে তবে অর্জন নিয়ে সন্দেহ নেই। সাংস্কৃতিক-সামাজিক-রাজনৈতিক অঙ্গনের লোকেরা রাজপথে নেমে ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা ফাঁসি আদায় করেছেন, যদিও এই ফাঁসি নিয়ে অনেকের দ্বিমত আছে। আমি ফাঁসি নিয়ে বলতে চাই না। ধর্ষণ, ধর্ষণের প্রতিকার নিয়ে বিগত দু’সপ্তাহ লিখেছি। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি কথাটা আজ বলতে চাই। আমরা ধর্ষকের ফাঁসি চেয়েছি, পেয়েছি। ধর্ষকদের প্রতি সমাজে ঘৃণাও এখন তীব্রতর হয়েছে- কিন্তু সমাজে ধর্ষিত নারীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে কি? মোটেও পাল্টায় নি।
মুখে মুখে ধর্ষিতার প্রতি সহানুভূতি দেখাই সত্য বাস্তবে নয়। বাস্তবে ক্ষেত্র বিশেষ ধর্ষক থেকে ধর্ষিতা সমাজে নিগৃহীত বেশি। ধর্ষণ একটি এক্সিডেন্ট, আর ১০টি দুর্ঘটনার মতোই। এ দুর্ঘটনা শুধু আর নারীর জীবনে সীমাবন্ধ নেই পুরুষদের জীবনেও আসছে। হুজুর থেকে পুরোহিত,পাদ্রি কারও হাতেই নিরাপদ নয় মেয়েরা, শিশুরা। কিন্তু ধর্ষিতার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি না পাল্টালে শুধু ধর্ষণের সাজা ধর্ষিতাকে শান্তি ও স্বস্তি দিতে পারে না। এখানে মিডিয়ার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। কিন্তু মিডিয়া কীভাবে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে, এনজিও কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে- তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই, গবেষণা নেই। সবাই ব্যস্ত সাজা দেওয়া নিয়ে।
মিডিয়া এখনও খোঁজ, ফলোআপ করতে পারেনি ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে হায়নাদের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হেনস্তার শিকার বাঁধনের। বাঁধন একটি সুস্থ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে। সে বলতে চেয়েছিল এই ধরনের উৎসব ছেলে-মেয়ের যৌথভাবে করার কথা। ইতরগুলো তার উপর হামলে পড়ে, তাকে প্রায় নগ্ন করে প্রমাণ করেছে- তারা যেটা করে সেটা সুস্থ কিছু না। গে উৎসব মাত্র, যেখানে বিপরীতলিঙ্গের উপস্থিতি নেই
পাশের দেশের টিভিতে কয়েক বছর আগে বলিউড অভিনেতা আমির খান ‘সত্যমেব জয়তে’ নামের একটি অনুষ্ঠান করে ধর্ষিতাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছিলেন। সেইসঙ্গে যারা সমাজের প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করেছেন, মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন, নিজেকে শেষ হয়ে যেতে দেননি- তাও তুলে ধরেছেন। আমির খান নারী ভ্রূণ হত্যা, শিশুদের ওপর যৌন হয়রানি, যৌতুক প্রথাসহ বিয়েকেন্দ্রিক অন্যান্য সামাজিক সমস্যা নিয়েও অনুষ্ঠান করেছেন। আমি মনে করি তা একটু নয়, নির্যাতিতাদের প্রতি ভারতীয় সমাজের মনোভাব বদলাতে অনেক সহায়তা করেছে। পাশাপাশি ধর্ষিতা, নির্যাতিতা, যৌন হয়রানীর শিকার শিশুদেরকে জুগিয়েছে বেঁচে থাকার সাহস।
অন্যদিকে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া- সবাই মিলে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার কিন্তু ধর্ষিতার প্রতি সত্যিকারের সহানুভূতি দেখাতে অনেক কৃপন। অনেক ধর্ষিতা পরিবার কর্তৃক নিগৃহীত। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। বিয়ে করা হোক আর অবিবাহিত হোক- ধর্ষিতার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো একই রকম। আমি বলব ক্ষেত্রবিশেষ ধর্ষকের প্রতি আমাদের যতটা ঘৃণা নেই, একজন ধর্ষিতাকে গ্রহণের ক্ষেত্রে অস্বস্তি আছে। একজন ব্যভিচারী পুরুষ কিনবা নারীর প্রতিও আমরা অতটা রক্ষণশীল নই যতটা ধর্ষিত নারীর প্রতি রক্ষণশীলতা দেখাই। একজন ধর্ষিতাকে আমরা সবাই মিলে ঘৃণা করি না সত্য কিন্তু তাকে আর দশ জনের মতো গ্রহণ করতে আমাদের সবার কেমন জানি আড়ষ্ঠতা আছে।
খুব সুন্দরভাবে সেই কথাগুলো তুলে ধরেছেন একজন নিগৃহীত নারী স্মৃতিকণা বিশ্বাস। তিনি লিখেছেন, [যেদিন আমাকে রেপড হতে হয়েছিল, সেদিন আমি ছিলাম ষোড়শী! একেবারে গ্রামের সাদাসিধা মেয়ে! আমাকে দুমড়ে মুচড়ে রক্তাক্ত করে ফেলে গেল! কোনমতে বেঁচে ফিরলাম সেদিন। তারপরে শুরু হলো সমাজ কর্তৃক মানসিক নির্যাতন! আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী অনেকেই আমার পরিবারসহ মানসিক নির্যাতন চালাতে থাকে। মনে জোর সঞ্চয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম। প্রথমদিকে প্রায় একমাস ক্লাশ করতে পারিনি, ক্লাশের সামনে ঢুকতে যাবো তখনি সহপাঠীদের অনেকেই কৌতূহল নিয়ে হা করে তাকাতো! প্রথমদিনই মানসিক আঘাত পেলাম এক সহপাঠীর ছুঁড়ে দেয়া মন্তব্যে! সে ধর্ষিতা স্মৃতি কনা এসেছে আমাদের সাথে পড়তে!…]
একেতো সংখ্যালঘু তার উপরে ছাত্রলীগ করার অপরাধ ১৯৯৫ সালে বরিশালের বিএম কলেজে ছাত্রদলের হাতে প্রকাশ্য নির্যাতিত হয়েছিল এই স্মৃতিকণা। মেয়েরা এখন হ্যাশট্যাগ মি টু আন্দোলন করছে, তার বহু আগে স্মৃতিকণা নির্যাতকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল। ধর্ষিতা হয়ে সে নিজেকে অপরাধী ভাবেনি বরং দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নিয়েছে। এতো সহজ ছিল না সব কিছু কিন্তু সে তা অতিক্রম করেছে। সম্প্রতি ফেইসবুকে তার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটিই যে সবাইকে জানিয়েছে। অথচ তার এই পজেটিভ গল্পটি সমাজকে জানানোর দায়িত্বটি তার ছিল না, ছিল আমাদের মিডিয়ার।
মিডিয়া এখনও খোঁজ, ফলোআপ করতে পারেনি ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে হায়নাদের হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হেনস্তার শিকার বাঁধনের। বাঁধন একটি সুস্থ সমাজের প্রতিনিধিত্ব করতে চেয়েছিল আজ থেকে ২০ বছর আগে। সে বলতে চেয়েছিল এই ধরনের উৎসব ছেলে-মেয়ের যৌথভাবে করার কথা। ইতরগুলো তার উপর হামলে পড়ে, তাকে প্রায় নগ্ন করে প্রমাণ করেছে- তারা যেটা করে সেটা সুস্থ কিছু না। গে উৎসব মাত্র, যেখানে বিপরীতলিঙ্গের উপস্থিতি নেই।
লেখার শুরুতে সন্দেহ প্রকাশ করেছি যে, ধর্ষণ বিরোধী এই আন্দোলনের ফল তাৎক্ষণিক পাওয়া গেলেও এটি অতীতে এই সংক্রান্ত আন্দোলনকে অতিক্রম করতে পেরেছে কিনা। আমার দৃষ্টিতে পারেনি। খালেদা জিয়া যখন প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন পুলিশ কর্তৃক ধর্ষণ এবং হত্যার শিকার হয়েছিল এক সাধারণ মেয়ে ইয়াসমিন। মাকে দেখার জন্য ঢাকা থেকে দিনাজপুরের বাড়িতে ফিরছিল কিশোরী গৃহকর্মী ইয়াসমিন এবং ভুল করে ঠাকুরগাঁওগামী নৈশকোচে উঠে পড়ে সে। বাসটি তাকে ভোরের দিকে দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, রংপুরের সংযোগ মোড় দশমাইল এলাকায় চায়ের স্টলে রেখে, বাসের সুপারভাইজার চায়ের দোকানদারকে ইয়াসমিনকে দিনাজপুরগামী একটি বাসে তুলে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
কিছুক্ষণ পরই সেখানে পৌঁছে টহল পুলিশের পিকআপ ভ্যান। পুলিশ ভ্যানচালক অমৃত লাল বর্মণ, পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মঈনুল এবং আব্দুস সাত্তার চায়ের দোকানে বেঞ্চে বসে থাকা ইয়াসমিনকে দিনাজপুর শহরে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে জোর করে পুলিশ ভ্যানে তুলে নেয়। এরপর তারা দশমাইলসংলগ্ন সাধনা আদিবাসী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইয়াসমিনকে গণধর্ষণের পর নিমর্মভাবে হত্যা করে তার মৃতদেহ রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। দিনটি ছিল ২৪ আগস্ট ১৯৯৫। আজ থেকে ২৫ বছর আগে।
ইয়াসমিন হত্যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো নারী সমাজকে, পুরো বাংলাদেশকে। দিনাজপুর কোতোয়ালি পুলিশ ‘একজন অজ্ঞাতপরিচয়ের লাশ উদ্ধার’ মর্মে ঘটনাটি সাজিয়ে থানায় একটি ইউডি মামলা করে এবং লাশের তড়িঘড়ি ময়নাতদন্ত শেষে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে বালুবাড়ি শেখ জাহাঙ্গীর গোরস্তানে দাফন করে রক্ষা পায়নি। বিভিন্ন মানবাধিকার ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বস্তরের জনসাধারণকে সঙ্গে নিয়ে ইয়াসমিন গণধর্ষণ ও হত্যার বিচারের দাবিতে গণ-আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। ১৯৯৭ সালের ৩১ আগস্ট রংপুরের জেলা ও দায়রা জজ আবদুল মতিন মামলার রায়ে আসামি মঈনুল হোসেন, আবদুস সাত্তার এবং অমৃত লাল বর্মণকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। ২০০৪ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাদের তিনজনের ফাঁসি হয়।
ধর্ষিতার প্রতি এই দেশ যথার্থ সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কিন্তু আমার বিশ্বাস ইয়াসমিন বেঁচে থাকলে সমাজ তাকে এই বিচার দিতো না। মৃত ইয়াসমিন জীবিত ইয়াসমিন থেকে শক্তিশালী হয়েছিল। আজ ইয়াসমিন হত্যার ২৫ বছর পর নারী, শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা এবং নির্যাতনের চিত্র পাল্টায়নি। কিন্তু বিচার পাওয়া সহজ হয়েছে একটু হলেও। মাত্র সাত কর্মদিবসে বাগেরহাট জেলার এক আদালত সাত বছরের ধর্ষিত মেয়েকে বিচার দিয়েছেন ধর্ষককে যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে। গত ১৯ অক্টোবর ২০২০-এর এই রায় বাংলাদেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের রায়ের ক্ষেত্রে নজিরবিহীন।
কিন্তু আমরা নজির রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি নির্যাতিত ও ধর্ষিতদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে মানুষের জীবনের আর ১০টি ঘটনার মতো বিবেচনা করে তাদেরকে সমাজে সুস্থভাবে বাঁচার ব্যবস্থা করতে। ভিকটিম ব্লেম কালচার থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। নারী কেন এমন ড্রেস পরলো, নারী কেন এই রাতে বের হল- সেই ভাঙা রেকর্ড বাজাচ্ছি। এই কালচার থেকে আমরা যদি বের না হতে পারি তাহলে ধর্ষণ বিরোধী আমাদের সমস্ত কাজ হবে মায়াকান্না এবং ভাওতাবাজি। ধর্ষণ একজন নারীর জীবনকে শেষ করে দিয়েছে এটা উন্নত বিশ্বে এখন বিরল চিন্তা। তাদের নারীবাদীরা এসব কথা সাহসের সঙ্গে প্রচার করছে। আমাদের এনজিওরা ফান্ড না থাকলে এসব নিয়ে কথা বলবে না কিন্তু নারীবাদীদেরকে তো এগিয়ে আসতে বাধা নেই, মিডিয়ার তো বাধা নেই- ধর্ষিতার প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর পক্ষে কাজ করতে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।