সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশের মিডিয়ার সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এ নিয়ে পর্যায়ক্রমে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হবে। ‘সামরিক বাহিনী ও গণমাধ্যম’ শীর্ষক এক সেমিনারে গতকাল এ তথ্য জানানো হয়। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এ ধরনের সেমিনারের আয়োজন করা হলো। অনুষ্ঠানে উভয় পক্ষের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করতে নানা ধরনের সুপারিশ ও পরামর্শ নিয়ে আলোচনা হয়। এছাড়া, কিভাবে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে দেশের স্বার্থে ভূমিকা পালন করা যায় তা নিয়ে আলোকপাত করা হয়। গতকাল রাজধানীর ট্রাস্ট মিলনায়তনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর এ সেমিনারের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সেনাসদরের চিফ অব জেনারেল স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মইনুল ইসলাম এডব্লিউসি, পিএসসি। তিনি বলেন, মিডিয়ার শক্তি অগ্রাহ্য করে সামনে যাওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়। আমরা কি চাইছি, মিডিয়া কি চাইছে এ দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্যই এই ধরনের সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, একে অপরের প্রতি আস্থা রাখা উচিত। সেনাবাহিনীর মধ্যে সমপ্রতি ব্যর্থ ক্যু চেষ্টা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ নিয়ে কাজ চলছে। শিগগিরই বিষয়টি নিয়ে জানানো হবে। এখনই কিছু বলা সম্ভব নয়। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী বিমানবাহিনীর ওপর আধিপত্য রাখে এটা ঠিক নয়। কারণ আমরা সবাই এক পরিবারের সদস্য। সেমিনারে তিনি বলেন, খবরের কাগজ বিশ্বাস করেই পাঠকরা তা কিনে পড়েন। এ কারণে মিডিয়া আজ শক্তিশালী মাধ্যম। বর্তমানে সবাই মিডিয়াকে তার পক্ষে ব্যবহারের জন্য চাইছে। এটা ইতিবাচক। সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য সংগঠন সব কাজ যে সঠিকভাবে কিংবা ভুলভ্রান্তি ছাড়া করছে তা ঠিক নয়। এসময় তিনি সাংবাদিকদের বিভিন্ন মতামতের প্রেক্ষিতে জানান, কথায় আছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে যাওয়া মানেই সবাই যে মুক্ত মনের তা নয়। কেউ কেউ অন্যের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহার হতে পারেন। এ নিয়ে আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। তিনি বলেন, প্রতিবারই বাজেট ঘোষণার আগে বলা হয়, সব বাজেট সেনাবাহিনীকে দিয়ে দেয়া হচ্ছে। মূলত এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেয়ার কর্তৃপক্ষ সরকার। তিনি বলেন, সেনাবাহিনীর অডিট রিপোর্টে হিসাবের পার্থক্য খুব কম থাকে। যেটুকু হয় তা পদ্ধতিগত ভুলের কারণে হয়ে থাকে। সেনাকর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পাওয়াটা কিছুটা দুরূহ-এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা সাংবাদিকতার লাইনআপ সুনির্দিষ্ট থাকলে ভাল হয়। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে সঠিক সময়ে তথ্য দেয়ার দুর্বলতা আমাদের রয়েছে। এটা দূর করতে কাজ চলছে। আশা করি, বিষয়টি নিয়ে দূরত্ব কমবে। এদিকে সেমিনারে জাতীয় শক্তির একটি অংশ হিসেবে সামরিক বাহিনীর ভূমিকা তুলে ধরা হয়। সেনাবাহিনীতে সমপ্রতি সংযোজিত সামরিক চেতনা ও মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও দেয়া হয়। এসময় বলা হয়, উল্লেখযোগ্য কয়েকটি সামরিক চেতনার মধ্যে রয়েছে, আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সদস্য, আমি সর্বদা মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং সংবিধানে বর্ণিত চেতনাকে সমুন্নত রাখবো, আমি আমার দেশকে ভালবাসি এবং দেশমাতৃকা ও দেশের সংবিধান রক্ষার্থে সর্বোচ্চ উৎসর্গ করতে সদাপ্রস্তুত। এছাড়া, নতুন সংযোজিত সামরিক মূল্যবোধের মধ্যে রয়েছে- সম্মান ও গৌরব, সততা ও সত্যনিষ্ঠা, আনুগত্য, দেশপ্রেম, আস্থা ও বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, ন্যায়পরায়ণতা, নিঃস্বার্থ পেশাগত দায়িত্ব, সাহসিকতা ও সহযোদ্ধাদের প্রতি সহমর্মিতা। সেমিনারে বলা হয়, সততা ও পেশাদারিত্বের সামরিক বাহিনীর চাকরি এবং সাংবাদিকতা দু’টোই মহৎ পেশা। সামরিক বাহিনী দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও জাতীয় নিরাপত্তার জন্য চরম আত্মত্যাগ করতে সদাপ্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই রাষ্ট্র ও সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সামরিক বাহিনী এবং গণমাধ্যমের পারস্পরিক সমন্বয় অতি জরুরি। এদিকে সেমিনারের শুরুতে বক্তব্য রাখেন সামরিক গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক (ডিএমআই) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রিদওয়ান আহমেদ এফডব্লিউসি, পিএসসি। তিনি বলেন, সামরিক বাহিনী সম্পর্কিত যে কোন তথ্য যথাযথ গুরুত্বসহকারে প্রকাশ করা না হলে অনেক সময় তা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। ক্ষেত্রবিশেষে তা জনসাধারণ, সেনাসদস্য ও তাদের আত্মীয়-স্বজনের জন্য উৎকণ্ঠার কারণ হয়। তিনি বলেন, এ ধরনের সেমিনারের মধ্য দিয়ে আজ থেকে প্রতিরক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নতুন যাত্রা শুরু হলো। আইএসপিআর-এর পরিচালক শাহীনুল ইসলাম বলেন, সশস্ত্র বাহিনীর কোন বিষয় বা ঘটনা সম্পর্কে জনগণকে অবহিতকরণের প্রয়োজন হলে আইএসপিআর-এর মাধ্যমে মিডিয়ায় পাঠানো হয়। এ ব্যাপারে সশস্ত্র বাহিনী ও আইএসপিআর উভয়কেই যথেষ্ট সাবধানতা ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। তিনি বলেন, কোন সংবাদপত্রে একটি ভুল সংবাদ ছাপা হলে অনেক সময় পরবর্তী সংখ্যায় প্রতিবাদ ছাপিয়ে দায়মুক্তি ঘটতে পারে। কিন্তু সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষে কোন ভুল বা অসঠিক তথ্য সরবরাহ করা হলে তা সামাল দেয়া কঠিন। তিনি আরও বলেন, আইএসপিআরকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়। কিন্তু কিভাবে তা অস্পষ্টই থেকে যায়। জনবল বাড়ালেই তা শক্তিশালী হবে না। তারা যে ফিল্ডে কাজ করেন সেখানে কর্তৃপক্ষ দরকার। সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব ভবন ও লজিস্টিক সমর্থন থাকা প্রয়োজন। সেমিনারে আইএসপিআর-এর সহকারী পরিচালক নুর ইসলাম একগুচ্ছ সুপারিশ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কোন সংবাদ কিল কিংবা ছাপানোর জন্য মিডিয়াকে চাপ দেয়া যাবে না। টেলিফোনে সাক্ষাৎকার দেয়াও ঠিক নয়। এক্ষেত্রে লিখিত সাক্ষাৎকার দিয়ে রিপোর্টারের স্বাক্ষর নেয়া যেতে পারে। তিনি বলেন, আইএসপিআর-এর পক্ষ থেকে কখনও বলা যাবে না নো কমেন্টস। প্রয়োজনে সময় নিয়ে, তথ্য জেনে তা জানাতে হবে। পারতপক্ষে কোন সংবাদের প্রতিবাদ না দেয়াই ভাল। কারণ মিডিয়া প্রতিবাদ পছন্দ করে না। যদি দিতেই হয় তাহলে তার ভাষা মার্জিত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, অর্থ দিয়ে কখনও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। এজন্য উপহার হিসেবে ডায়েরি, ক্যালেন্ডার বা কলম দেয়া যেতে পারে। অনুষ্ঠানে জেনারেল স্টাফ অফিসার-ওয়ান (জিএসও-১) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ আল মামুন সঞ্চালকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি নিজের মতামত তুলে ধরেন। এসময় সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিংস দেখানো হয়। এদিকে সেমিনারে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা তাদের নানা পরামর্শ ও সুপারিশ তুলে ধরেন। বিশেষ করে তারা আইএসপিআরকে আরও শক্তিশালী করার পক্ষে মত দেন। প্রতিষ্ঠানটিকে ঠুঁটো জগন্নাথ না বানিয়ে দ্রুত তথ্য সরবরাহের দাবি জানানো হয়। এছাড়া, ক্যান্টনমেন্টে সাংবাদিকদের গাড়ি প্রবেশের কড়াকড়ি নমনীয় করার কথা বলা হয়। একই সঙ্গে আইএসপিআর-এর নিজস্ব ওয়েব সাইট চালুর পরামর্শ দেন সংবাদকর্মীরা। সেমিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবুল মনসুর, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ এবং নৌ ও বিমান সদরের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।