বার্তা৭১ ডটকমঃ নিজের অটোবাওগ্রাফির নাম দিয়েছিলেন কিলিং টাইম। বুঝতেই হবে খুব বেশি সরল-সোজা মানুষের কম্ম সেটা না। নিজের সবচেয়ে আপন জীবনটাকে যিনি অহেতুক আর জঞ্জাল মনে করেন তিনি আর যাই হোক অতি সাধারণ যে কেও হতে পারেননা, সেটা বুঝতে বুঝি কারো অসুবিধে হয় না। নানাবিধ কারণে তাইতো তাঁকে আখ্যা দেয়া হয়েছে সমকালের নিটশে। এ যেন নজরুলের ‘বিদ্রোহী’: ‘আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল, আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল’। ছিলেন ভীষণ বাতিকগ্রস্থ, খ্যাপাটে, বেপরোয়া, আর অসম্ভব সন্দেহপ্রবণ একজন মানুষ। সারাজীবন ভাঙা স্পাইনাল কর্ড নিয়ে চলা একজন মানুষের জীবনটা যে এমন হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়! কিন্তু আসলেই কি তাই? শুধুমাত্র শারীরিক ত্রুটির কারণেই কি তিনি এমন চরিত্রের ছিলেন? মোটেও না। সবকিছু নিয়ে তাঁর এই বিপরীত স্রোতে সাঁতার দেয়ার কারণটা শুধুমাত্র শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যে নয় সেটা তাঁর বড় বড় কালজয়ী লেখাতে প্রমাণ মেলে। অর্থাৎ প্রচলিত চিন্তা ও বিজ্ঞানের চলমান স্রোতের বিপরীতে তাঁর অবস্থান সম্পূর্ণ দর্শনগত। বিষয়টা একটু পর খোলসা হবে। কথা বলছি সমকালের সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত অস্ট্রিয়ান দার্শনিক পল ফায়ারাব্যান্ড(১৯২৪-১৯৯৪)-কে নিয়ে। আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক রবার্ট হলিঞ্জার লিখছেন, ফায়ারাব্যান্ডের ভেতর ছিল প্রাচীন উদারতাবাদ ও বিচারমূলক বুদ্ধিবাদী ধারার এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ যা বলতে গেলে তাঁর সমকালীন দার্শনিক কার্ল পপারের বিপরীত ধারা এবং অবশ্যই সক্রেটিস ও মিলের মানবতাবাদী প্রক্ষেপণের ভীষণ কাছাকাছি। হলিঞ্জার মনে করেন, এই ধারার অন্যান্য সদস্যরা হলেন, প্রাচীন সোফিস্ট, নিটসে, ভিটগেনস্টাইন, প্রেগমেটিস্ট ও এক্সিটেনসিয়ালিস্টরা(Freedom, Reason and Tradition, Reason papers, No.6, Spring 1980, 83-91 )।তবে অন্যরা যে যাই বলুক ফায়ারাব্যান্ড নিজে এই বিতর্কের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। তিনি তাঁর ম্যাগনাম ওপাস Against Method এর সাবটাইটেল দিয়েছেন Outline of an Anarchistic Theory of Knowledge অর্থাৎ জ্ঞানের একটা নৈরাজ্যকর তত্ব। নিজেকে একজন এনার্কিস্ট হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, সমসাময়িক সব ধারার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন এমনকি, অত্যন্ত প্রভাবশালী পজেটিভিস্ট কিম্বা পপার থেকেও নিজেকে দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন। Against Method এর শুরুটা করছেন এভাবে, “পরবর্তী লেখাগুলোতে আমি এটাই বলতে চাইছি, যদিও নৈরাজ্যবাদ খুব বেশি একটা আকর্ষণীয় রাজনৈতিক দর্শন হিসেবে সমাদৃত হয়নি তবু নিশ্চিতভাবে এটা জ্ঞানচর্চার সবচেয়ে মোক্ষম হাতিয়ার, বিশেষকরে বিজ্ঞানের দর্শনের জন্য”।
কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার! কিন্তু মনে রাখতে হবে তাঁর এনার্কিজম পুরোপুরি এপিস্টিমলজিক্যাল। মূলত বিজ্ঞানের সামগ্রিক চরিত্র নিয়ে তাঁর সংশয় এবং এর পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর বিশেষ অবস্থানের জন্য তিনি নিজেই নিজেকে একজন এনার্কিস্ট বলেছেন। ১৯৮৭ সালে দু’জন ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী NATURE জার্নালে Where Science Has Gone Wrong শিরোনামে একটা গবেষণা প্রবন্ধে কার্ল পপার, টমাস কুন ও পল ফায়ারাব্যান্ডকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আখ্যা দেন। বিশ্বাসঘাতক কথাটা উল্লেখ করেছেন এ জন্য যে বিজ্ঞানের পদ্ধতিকে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়েছেন যার প্রেক্ষিতে তিনি তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বইটার নাম রেখেছেন Against Method। পরে আসছি সে কথায়। ভিয়েনার একটা মধ্যবিত্ত ঘরে ১৯২৪ সালে জন্মছিলেন পল কার্ল ফায়ারাব্যান্ড। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে ভিয়েনার অবস্থা ছিল অত্যন্ত নাজুক। দুর্ভিক্ষ মারামারি আর অর্থনৈতিক মন্দা পুরো ইউরোপকে কাহিল করে ফেলে। ঠিক এই সময় ছোট্ট একটা এপার্টমেন্টের মাঝে জন্মেছিলেন পল। শৈশবকাল কাটে বড্ড নিরানন্দে। সঙ্গহীন ফায়ারাব্যান্ড বেড়ে উঠেন অন্য ধাঁচে। তাঁর জগত ছিল ছোট শোবার ঘর আর রান্না ঘর অবধি। বাইরের থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ফায়ারাব্যান্ড মনে করতেন, ‘এই পৃথিবীটা সত্যি খুব ভয়ঙ্কর একটা জায়গা’। ভগ্ন স্বাস্থ্যের অধিকারী ফায়ারাব্যান্ড স্কুলে গিয়ে পড়েন বিপাকে। সবকিছু নতুন আর বেদনাময় মনে হয় তাঁর কাছে। তবে হাইস্কুলে উঠে তিনি অসম্ভব মেধার পরিচয় দিতে থাকেন এবং পান Vorzugsschüler উপাধি যার অর্থ তিনি তাঁর বয়সের থেকেও বেশি গ্রেড অর্জনের ক্ষমতা রাখেন। মাত্র ১৬ বছর বয়েসে তিনি তাঁর শিক্ষক থেকেও বেশি জ্ঞানের পরিচয় দেন বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান আর গণিতে। ইঁচড়ে পাকা স্বভাবের বিষয়টা সেসময়য় শিক্ষকরা বুঝে গেছেন। তাঁর স্কুল শিক্ষক অস্টওয়ার্ল্ড টমাস তাঁকে পদার্থবিজ্ঞান আর জ্যোতির্বিদ্যার ওপর আগ্রহ জাগান। এর প্রেক্ষিতে তিনি তাঁর বাবার সহায়তায় একটা টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন যেটা দিয়ে তিনি Swiss Institute of Solar Research থেকে নিয়মিত আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন। পড়েছেন বিজ্ঞানের ইতিহাস, আর্নেস্ট মাখ, এডিংটন আর হুগো ডিংলারের মতো পদার্থবিজ্ঞানীর দর্শন আর তাঁদের নানারকম চিন্তা-প্রতিচিন্তা। ১৯৩৮ সালে অস্ট্রিয়া জার্মানির সাথে একীভূত হয়। হিটলারের বাহিনী একের পর এক ইহুদী নিধনে মেতে উঠে। এসবের খুব একটা খোঁজ খবর নিতেন না ফায়ারাব্যান্ড বরং হিটলারের বাগ্মিতা তাঁকে ভীষণ আকৃষ্ট করত। আশ্চর্যের ব্যাপার তিনি লিখছেন, যুদ্ধের সেই ধংসযজ্ঞ শেষে তিনি জেনেছিলেন পেপার পত্রিকা-টেলেভিশনের মাধ্যমে। তবে যুদ্ধের কোন প্রভাব তাঁর মনের ওপর পড়েনি বলে তিনি দাবি করেন। যেটা তিনি করতে চেয়েছেন সেটা শুধু মাত্র এই যুদ্ধের একটা নিরপেক্ষ দর্শক হিসেবে ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়া পর্যন্ত। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার আগে তাঁকে জার্মান সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে ট্রেনিং এ পাঠানো হয় পিরামেসেন্সে। এরপর দীর্ঘদিন সেখানে অতিবাহিত করেন। যুদ্ধের ভেতর একটা বুলেট তাঁর স্পাইনাল কড ভেঙে ফেলে, তিনি হয়ে পড়েন ইমপোটেন্ট। সারাজীবন এভাবেই কাটাতে হয় তাঁকে। জানা যায় তিনি চার বার বিবাহ বন্ধনেও আবদ্ধ হন। অত্যন্ত অস্বস্তিকর সেসব বিবাহ বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। যুদ্ধ শেষে ফায়ারাব্যান্ড এপলোডার মেয়রের কাছে একটা চাকরির জন্য যান এবং সেখানাকার শিক্ষা বিভাগে একটা চাকরিও পান। ১৯৪৬ সালে পক্ষাঘাত থেকে কিছুটা সেরে উঠলে উইমিয়ারে একবছর লেখাপড়ার জন্য পান স্টেট ফেলোশিপ।
দর্শনের প্রতি আকর্ষণ যুদ্ধ শেষে ফিরে ফায়ারাব্যান্ড মনস্থির করেন তিনি ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞান, গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার ওপর পড়াশুনা করবেন। ইতিহাসের ওপরেও তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল। কিন্তু পড়াকালীন তিনি দর্শনের ওপর সভা সেমিনারে নিয়মিত যোগ দিতেন। তবে ইতোপূর্বে যৌক্তিক প্রত্যক্ষবাদের স্বর্ণযুগে তিনি এর দ্বারা প্রভাবিত হন ভীষণভাবে। সে সময় ফ্রেগের লজিক, ভিটগেন্সটাইনের লজিক্যাল এটমিজম, রাসেল-হোয়াইটহেডের Principia Mathematica তাঁকে দারুণ আগ্রহী করে তোলে। ১৯৪৮ সালের দিকে কার্ল পপারের সাথে সাক্ষাৎ হয়। পপার তখন ঘোরতর পজিটিভিস্ট বিরোধী। বিজ্ঞান নিয়ে পপারের ভিন্ন সুর তখন বেশ চাউর হতে শুরু হয়েছে। বিজ্ঞানের পদ্ধতি হিসেবে আরোহের পরিবর্তে অবরোহ বেশ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করলে ফায়ারাব্যান্ড অন্তত কিছু সময়ের জন্য পপারিয়ান হয়ে উঠেন। পপারের মুক্তচিন্তা এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি তাঁকে আকর্ষণ করতো। কিন্তু পপারের অবরোহী পদ্ধতির সাথে তিনি আগেই পরিচিত ছিলেন বিশেষ করে ভিয়েনা সার্কেলের অন্যতম সদস্য ভিক্টর ক্রাফটের লেখা থেকেই তিনি সম্যক ধারণা পান। এ সময় অ্যাল্পবাকে অন্তত ১৫টা সিম্পজিয়ামে তিনি অংশ নেন এবং সেখানকার বেশ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন। অ্যাল্পবাকে ওয়াল্টার হলিটচার নামে একজন কম্যুনিস্ট বুদ্ধিজিবির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় যিনি পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক এবং ভালো বন্ধু হয়ে ওঠেন। ১৯৫৭ সালের দিকে ফায়ারাব্যান্ড বেশ কিছু পেপার লেখেন যেখানে তিনি তাঁর অবস্থান পরিষ্কার করে বলেন, বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য তাকে পজেটিভিজম ছেড়ে রিয়েলিজমের দিকে এগুতে হবে। ১৯৪০ ও ১৯৫০ এর দশকে ফায়ারাব্যান্ড সবচেয়ে বেশি দার্শনিক ভাবনার মুখোমুখি হন বিশেষ করে ভিক্টর ক্রাফট গ্রুপের সদস্য হলে অনেকের সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠে। এর ভেতর ছিলেন বিলা ভন জুহস, গেওর্গ হেনরিক ভন রাইট, ওয়াল্টার হলিটজার, এলিজাবেথ এন্সকম্ব এবং ভিটগেনস্টাইন। ভিটগেনস্টাইন তখন ভাষা দর্শনের পরিবর্তিত এক ধাপ নিয়ে গবেষণা করছেন। তাঁর ইনভেস্টিগেশনে এর পরিচয় মেলে। ভাষার অ্যাপরাইওরি ফর্ম থেকে অ্যাপস্টেরিওরি ফর্ম এবং তার সরল রৈখিক ব্যবহার থেকে বহুমুখী ব্যবহারের দিকে ভিটগেনস্টাইন তখন গবেষণায় নিমগ্ন। ১৯৫১ সালে মারা যাবার আগ পর্যন্ত ফায়ারাব্যান্ডের সাথে ভীষণ সখ্য ছিল। এর আগে ১৯৪৯ সালে আরেক দার্শনিক বার্টলট ব্রেখটের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। ব্রেখট তাঁকে তার সহকারী হিসেবে কাজ করার অনুরোধ করেন, কিন্তু ফায়ারাব্যান্ড তা প্রত্যাখ্যান করেন। এটা তাঁর চরম একটা ভুল ছিল বলে তিনি পরবর্তীতে উল্লেখ করেন। ১৯৫৩ সালে কার্ল পপার তাঁকে নিজের সহ গবেষক হিসেবে পেতে ছেয়েছিলেন কিন্তু পপারের চিন্তার সাথে বনিবনা না হওয়ার ফলে তিনি ভিয়েনাতে ফিরে যান। অর্থ কষ্টে পড়ে এসময় তিনি কিছু ফরমায়েশ কাজ করেন যার মধ্যে কিছু পপারের লেখার অনুবাদও ছিল। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির জন্য আবেদন জানান এসময়। আর্থার প্যাপ ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্লেষণী দর্শনের ওপর বক্তৃতা দিতে এলে তিনি কিছু দিন তাঁর সহকারী হিসেবে কাজ করতে রাজি হন। ১৯৫৪ সালে নতুন পদার্থবিজ্ঞান অর্থাৎ কোয়ান্টাম বলবিজ্ঞান নিয়ে গভীর গবেষণায় নিমগ্ন হন। কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে তখন পদার্থবিজ্ঞান জগতে পক্ষেবিপক্ষে তুমুল লড়াই চলছে। এই বিতর্কে তিনি জড়িয়ে পড়েন। তিনি মনে করেন কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনের মাধ্যমে পদার্থের অতি ক্ষুদ্র চারিত্রিক বৈশিষ্ট নিরূপণ করা অসম্ভব। আমরা আগেই জানি হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র আমাদের একটা নিদারুণ ভৌত বাস্তবতায় পৌঁছে দিয়েছে যেখানে একই সাথে ইলেকট্রনের ভর ও গতিবেগ নিরূপণ সম্ভব না। পপার মনে করতেন কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশন হচ্ছে নিলস বোর, হাইজেনবার্গের কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের একটা সীমিত ব্যাখ্যা যা মূলত পজিটিভিস্টদের দ্বারা প্রলুব্ধ তাঁরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছান। অর্থাৎ বিজ্ঞানের এই ধরণের ব্যাখ্যা মানুষের অভিজ্ঞতাজাত সহজ ও সাশ্রয়ী প্রতিবেদন। কিন্তু ফায়রাব্যান্ড মনে করতেন কোপেনহেগেন ইন্টারপ্রিটেশনের একটা চমৎকার দিকও আছে যা দিয়ে শুধু অদৃশ্যমান সাব-এটোমিক পার্টিক্যালের গতিপ্রকৃতিই ব্যাখ্যা করা যায়না বরং দৃশ্যমান ফলাফলকেও ব্যাখ্যা করা সম্ভব। ১৯৫৫ সালে তিনি ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পান। এসময় কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানী ডেভিড বহামের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বেশ কিছু কাজ করেন। এর দু’বছর পর তিনি Colston Research Symposium সেন্টারে গবেষণাপত্র পেশ করেন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের ওপর। পরের বছর ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়াতে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে চাকরি করার সুযোগ পান, সাথে সাথে সুযোগ পান আমেরিকাতে স্থায়ীভাবে থাকারও। পুরো ৬০ এর দশক জুড়ে পদার্থবিজ্ঞানের ওপর নানা দার্শনিক আলোচনায় তিনি গভীর মনোনিবেশ করেন। এবং ১৯৭০ এর শুরুতেই এপিস্টিমলজিক্যাল অ্যানার্কিজমের দিকে ঝুঁকে পড়েন এবং লেখেন Against Method। ১৯৬৬ সালের গ্রীষ্মে তিনি চার্চের ডগমার বিরুদ্ধে লেকচার দেন। তিনি মনে করেন বিজ্ঞানের নানারকম অগ্রগতির সাথে সংগতি রেখে চার্চের অন্ধত্বও বেড়েছে। ১৯৭০ এর শুরুতে তিনি ইউনিভার্সিটি অব অকল্যান্ডে কিছুদিনের জন্য অধ্যাপনা করেন। পরবর্তীতে তিনি ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের দর্শনে একটা নতুন তত্বের দিকে ধাবিত হন যেটাকে আমরা বলি “এনিথিং গোজ ইন সায়েন্স” যেটা তাঁর এপিস্টিমলজিক্যাল অ্যানার্কিজম প্রতিষ্ঠার মূল ভূমিকা পালন করে। ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে ক্যালিফোর্নিয়াতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে তিনি চলে আসেন ইতালিতে। এরপর কিছুদিন কাটান সুইজারল্যান্ডে। সুইজারল্যান্ডে তিনি চিকিৎসাধীন সময়ে ১৯৯৪ সালে ব্রেইন টিউমারে মৃত্যু বরণ করেন। এরপর তাঁর কয়েকটা বই প্রকাশিত হয় যার মধ্যে অন্যতম তাঁর আত্মজীবনী কিলিংটাইম আর কনকয়েস্ট অব অ্যাবান্ডেন্স।
রিলেটিভিজমের দিকে যাত্রা
পল ফায়ারাব্যান্ডের শেষের দিকের অবস্থান পরিষ্কার করতে আমরা তাঁর তাত্বিক নৈরাজ্যবাদ ও বিজ্ঞানের সামগ্রিক চরিত্র নিয়ে তাঁর অবস্থানের দিকে দৃষ্টি দেই। তিনি বিজ্ঞান এবং এর পদ্ধতি নিয়ে কী বলছেন? এই ফাঁকে বলে রাখি দার্শনিক ইম্রে ল্যাকাটোস একবার তাঁকে বলেছিলেন, “পল, তোমার এই সব অদ্ভুত ধারণাগুলো কেন লিখে রাখছ না”। ফায়ারাব্যান্ড উত্তর দিলেন, “ আমি কথা দিচ্ছি এসব অতি শিঘ্র প্রকাশ করবো”। এই ‘অদ্ভুত’ কথাগুলোই সত্যি সত্যি তিনি প্রকাশ করলেন তাঁর Against Method বইয়ে। আর যে কথাগুলো প্রকাশ করলেন সেটা নিয়েই আমাদের আলোচনা। বইয়ের শুরু করলেন এই ভাবে “Science is an essentially anarchic enterprise: theoritical anarchism is more humanitarian and more likely to encourge progress than its law-and- order alternatives”। বিজ্ঞান হচ্ছে অত্যন্ত সুগঠিত, সুশৃঙ্খল, পদ্ধতিতাত্বিক, পরীক্ষামূলক, পুনরুৎপাদনমূলক, এবং নিসন্দিগ্ধ জ্ঞান। তাহলে ফায়ারাব্যান্ডের কথাগুলো বিজ্ঞানের এই সামগ্রিক চরিত্রের সাথে ভীষণ সাঙঘর্ষিক মনে হচ্ছে না? এর পরপরই তিনি আবার বলছেন, “ইতিহাস হচ্ছে দুর্ঘটনা আর কঞ্জেকচার এবং সাথে সাথে পারস্পারিক ঘটনাসমূহের মধ্যে এক কাকতালীয়ভাবে মিল ছাড়া অন্য কিছু না”। অর্থাৎ তিনি কোন রাখ ঢাক না রেখে বলছেন, বিজ্ঞান হলো অত্যন্ত বিশৃংখল আর জগাখিচুড়ি মার্কা এক জ্ঞানের শাখা যার কোন একক চরিত্র নেই। এমনকি এর ভেতর আছে ভুলভাল আর বিশ্রী ধরণের স্ববিরোধিতা। বিজ্ঞানের নানারকম পথ ও পদ্ধতি নিয়ে সমস্ত দার্শনিক মতপার্থক্য বস্তুত আসার। পল ফায়ারাবেন্ড মনে করেন বিজ্ঞান, ইতিহাস, নৃতত্ব, মনোবিদ্যা অথবা যে কোন বৈদ্ধিক চর্চা সবই একই ধরণের। বিজ্ঞানের সাথে মিথের কোন পার্থক্য নেই। এরা যেন একই বৃন্তের দুটো আলাদা ফুল, জীবনের এক একটা ভিন্ন ভিন্ন আকার, ভিটগেন স্টাইন যেমনটা বলেছেন। সেখানে বিমূর্ত ধারণা, তত্ব, এবং মানদণ্ড প্রকারন্তরে অর্থহীন। তিনি দ্বিধাহীনভাবে উল্লেখ করেন, কোন বিশেষ ধরা বাঁধা আইন মানুষের স্বাধীনতার প্রতিবন্ধক। তাই বিজ্ঞানকে যদি সম্পূর্ণরূপে বৈদ্ধিক হতে হয়, যদি সত্যের কাছাকাছি পৌছাতে হয় তাহলে অবশ্যই তাকে আইনের কঠোর আগল থেকে মুক্ত হতে হবে। যুক্ত হতে হবে মানব চিন্তার নানাবিধ উপাচারের সঙ্গে। এ কারণে তিনি বলেন, সেক্ষেত্রে আমাদেরকে একটা বাধাহীন নৈরাজ্যের কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতেই হবে। আত্মসমর্পণ করতে হবে অন্তত দু’টো কারণেঃ প্রথমত, মনে করতে হবে ভ্রান্তিবাদ বা ফলিবলিজম মানুষের অজ্ঞানতার সাথে খুব করে জড়িয়ে আছে। কারণ আমরা হয়তো চূড়ান্ত সত্য কোনোদিন জানতে পারবো না; দ্বিতীয়ত, সবকিছুর উর্ধে মানুষের স্বাধীনতা বা চিন্তা করার মতো নির্বারিত পরিবেশ। কিন্তু ফায়ারাবেন্ড মনে করেন বিজ্ঞান ও দর্শন জ্ঞানের এ দু’টো বিষয়ই আজ আইন ও শৃঙ্খলার হাতে বন্দী। তিনি লিখছেন, “The attempt to increase liberty, to lead a full and rewarding life, and the corresponding attempt to discover the secrets of nature and of man entails, therefore, the rejection of all universal standards and of all rigid traditions.”। (p.20)।
বিষয়টা একটু পরিস্কার করলে এই দাঁড়ায় যে বিজ্ঞানের পদ্ধতি যুগে যুগে এক রকম ছিলনা। কোন বিজ্ঞানীই খুব বেশি পদ্ধতি সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে বিজ্ঞান আবিষ্কারে মনোযোগ দেননি। ১৮৯৯ সালে বেঞ্জিনের রাসায়নিক গঠন আবিষ্কার করতে অগাস্ট ক্যাকুল যখন গলদঘর্ম তখন তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে ভেবে দেখেন যে, একটা সাপ গোল হয়ে নিজের লেজ নিজেই কামড়ে ধরেছে। অর্থাৎ এটা দেখতে অনেকটা ষড়ভুজের মতো দেখাচ্ছে। তখন ক্যাকুল চিৎকার করে বললেন, “আগে স্বপ্ন দেখতে শেখ, তারপর সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাও”। তাহলে কী দাঁড়ায়? স্বপ্ন বা মিথ হলো সত্যের বাতিঘর। এ যেন গৌড়ের কবির মতো, “জগতে সকলি মিথ্যা সব মায়া ময়,/ স্বপ্ন শুধু সত্য আর সত্য কিছু নয়”।
তিনি এজন্য একটা কাউন্টার ইন্ডাকশানের প্রস্তাব করেন। অর্থাৎ তিনি বলতে চাইছেন, বিদ্যমান তত্বের ভেতর যদি কোনটা অসংলগ্ন মনে হয় তখন নতুন একটা বিকল্প আমাদের খোঁজ করতে হবে। এটাকে অবশ্য প্রিঞ্ছিপাল অব প্রলিফারেশনও বলে। এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি তিনি পেয়েছেন মিল, পায়ার্স কিম্বা পাপরের কাছ থেকে। তিনি বলছেন, ‘Knowledge is not a series of self-consistent theories that converges towards an ideal view; it is not a gradual approach to the truth. It is rather an ever increasing ocean qf mutually incompatible (and perhaps even incommensurable) alternatives, each single theory, each fairy tale,”। এখন আমরা বুঝতে পারছি কেন তিনি তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলা হয়েছে। বিজ্ঞানকে যিনি রূপকথার গল্পের সাথে তুলনা করেন তাঁকে এ ছাড়া আর কিই বা বলা সম্ভব?
লেখক: ড. সিদ্ধার্থ শংকর জোয়ার্দ্দার,অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।