ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা বলেছেন, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অবশ্যই সংলাপ হতে হবে। সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কার্যকর সংলাপ এবং সমঝোতা হবে আশা করে তিনি বলেন, এ দেশে সংস্কৃতিতে গণতন্ত্র রয়েছে। এজন্য এখানে অন্য শাসন স্থায়ী হতে পারেনি। এটা জোর দিয়েই বলা যায় সব দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে তারা আলোচনা করবেন এবং এর মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছাবেন। তা কখন হবে এটা হয়তো স্পষ্ট করে বলা যাবে না, তবে এ সংলাপ-সমঝোতা যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল। গতকাল গুলশানের লেকশোর হোটেলে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত এসব কথা বলেন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ (বিআইপিএসএস) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। প্রায় দু’ঘণ্টার এ আলোচনায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত দেশের চলমান রাজনৈতিক ও মানবাধিকার পরিস্থিতি, গুম-হত্যা, হরতাল, রাজপথে সংঘাত, সীমান্তে হত্যা-নির্যাতন, হিলারি ক্লিনটনের সফর, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড ও গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতায় ব্যবসা-বাণিজ্য বিশেষ করে রপ্তানিতে এর প্রতিক্রিয়াসহ দু’দেশের সম্পর্কের নানা বিষয়ে আয়োজক সংগঠনের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) মনিরুজ্জামান এবং উপস্থিত বিশিষ্টজনদের প্রশ্নের জবাব দেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সংলাপের আহ্বানের পুনরুল্লেখ করে ড্যান মজিনা বলেন, বড় দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের উপায় নিয়ে ঐকমত্য হতে হবে। নির্বাচনের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ। এক প্রশ্বের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রদূতরা কাউকে আলোচনার টেবিলে বসান না। তারা আলোচনার আহ্বান ও পরামর্শ দিয়ে ইস্যুটি উত্থাপন করেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যা রাজনৈতিক দলগুলোকেই আলোচনা করে সমাধান করতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত ব্যক্তিগতভাবে হরতাল ঘৃণা করেন জানিয়ে বলেন, পরিস্থিতি যা-ই হোক হরতাল দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না। এর বিকল্প ভাবার সময় এসেছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তৈরী পোশাক শিল্প বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি বড় খাত। পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে বাংলাদেশ এক নম্বর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সাপ্রতিক কয়েকটি ঘটনায় এ শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকদের অবস্থা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশের ক্রেতারা উদ্বিগ্ন। তারা প্রতিনিয়ত উদ্বেগ প্রকাশ করছেন জানিয়ে মজিনা বলেন, তিন দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের বড় একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও আমাকে মধ্যরাতে ফোন করে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক খবরের বিষয়ে তার দুশ্চিন্তার কথা জানান। একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনে তার সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলেও জানান। রাষ্ট্রদূত বলেন, দু’দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের পক্ষে জন্য কাজ করে এমন ৬ জন বাংলাদেশী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সেক্টর এবং শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে তাদের অসন্তোষের কথা জানান। আমিনুল হত্যার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, এ নিয়ে সমপ্রতি ঢাকা সফর করে যাওয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন সরকারের সঙ্গে কথা বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্র এ ঘটনার দ্রুত তদন্ত এবং বিচার আশা করে বলে পুনর্ব্যক্ত করে রাষ্ট্রদূত বলেন, আমিনুলের হত্যা হয়তো বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের কাছে এটি বড় ঘটনা। সেখানকার শ্রমিক সংগঠনগুলো এজন্য তার সরকারের কাছে চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে টিকফা চুক্তি প্রসঙ্গে মজিনা বলেন, চার বছর ধরে এ নিয়ে কাজ চলছে। বাংলাদেশের শ্রমমান সম্পর্কিত বিষয়ে এখনও কিছুটা দূরত্ব রয়েছে। এ চুক্তিতে দেরি হলে শ্রমমান উন্নত করতে বাংলাদেশের দেয়া প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে বিশ্বে নেতিবাচক বার্তা যাবে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। পরক্ষণেই এক প্রশ্নে রাষ্ট্রদূত আশা করেন, আলোচনার মাধ্যমে তারা ঐকমত্যে এবং চুক্তিতে উপনীত হতে পারবেন। গুম-হত্যা প্রসঙ্গে মজিনা বলেন, হিলারি ক্লিনটন স্পষ্ট করে বলেছেন, ইলিয়াস আলীর নিখোঁজের ঘটনাসহ সব গুমের ঘটনা তদন্ত এবং এর সুরাহা করা নিরাপত্তা বাহিনীর দায়িত্ব। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে বাংলাদেশ সরকার সব গুমের ঘটনা উদঘাটন করবে। আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদন প্রকাশিত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছরের চেয়ে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে গেলেও এ বছর নিখোঁজ হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। আগামী প্রতিবেদনে গুমের ঘটনাগুলো বেশি গুরুত্ব পাবে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্যরা নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি পরিবারকেও সহযোগিতা করছে। এ প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশ গর্ব করতে পারে। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশীদারে পরিণত হয়েছে পুনরুল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনসহ যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সফরই প্রমাণ। বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ছয়টি কারণ উল্লেখ করেন মজিনা। বলেন, প্রথমত, বাংলাদেশকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক উন্নয়ন করছে, যা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন। তৃতীয়ত, ১০ হাজার ৫০০’র বেশি সেনা পাঠিয়ে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে, যা আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় একটি বড় পদক্ষেপ। চতুর্থত, ৭০০ কোটির এই বিশ্বে কিছুদিন পরই জনসংখ্যা ৯০০ কোটি পেরিয়ে যাবে, এই অবস্থায় বাংলাদেশ তার নিজেদের খাবার নিজেরাই উৎপন্ন করছে। পঞ্চমত, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বাড়ছে। ষষ্ঠত, মানবাধিকার ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্র এদেশে সহায়তা বাড়িয়ে চলেছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে একটি উন্নত ও আধুনিক সেনাবাহিনী হিসেবে দেখতে চাওয়া শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নয় বরং এটা বিশ্বশান্তিসহ সামগ্রিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই প্রয়োজন। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায় জানিয়ে মজিনা বলেন, আমি বিশ্বাস করি, এমন একটি বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভাল হবে। এক প্রশ্নের জবাবে দিল্লির মাধ্যমে বাংলাদেশের কোন বিষয় নিয়ে তিনি ওয়াশিংটনে যোগাযোগ করেন না বলে জানান। বলেন, দিল্লির যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের নাম্বারও আমি জানি না। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরকে দু’দেশের সম্পর্কের বড় সাফল্য দাবি করে তিনি বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনির নেতৃত্বে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে হিলারি ৯০ মিনিট ধরে কথা বলেন। সে সময় আমি দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম, ততক্ষণে তার অন্য কর্মসূচি প্রায় ৩০ মিনিট দেরি হয়ে যাচ্ছিল। রাষ্ট্রদূত বলেন, হিলারির সফরের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা-সংলাপ বিষয়ক সমঝোতা সই হওয়া। এ সংলাপের মাধ্যমে দুই দেশের সব কিছুই আলোচনা করা সম্ভব। মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট প্রসঙ্গে মজিনা বলেন, গ্রহীতা দেশের চাহিদা ও যোগ্যতার ওপর এই অ্যাকাউন্ট থেকে অর্থ প্রাপ্তি নিশ্চিত হয়। এখানে ওয়াশিংটনের কিছুই করার নেই। সমুদ্রসীমা সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলাদেশের নিজেদের সমুদ্র সম্পদ নিজেরাই রক্ষা করতে সক্ষম হবে- এটাই যুক্তরাষ্ট্র দেখতে চায়। এদেশের গভীর সমুদ্র বন্দর দক্ষতার সঙ্গে নির্মিত হবে এবং পরিচালিত হবে সেটাই আশা তার সরকার। এ ধরনের একটি প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রও পাশে থাকতে চায় বলে জানান তিনি। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রসঙ্গে মজিনা বলেন, ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আগের চেয়ে বেড়েছে। আমি এখানে আসার পর প্রতিদিন ২০০ ট্রাক যেতো, এখন প্রতিদিন ৪০০ ট্রাক যাচ্ছে। এ সময় সীমান্ত হত্যা গ্রহণযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন তিনি। স্পষ্ট করে বলেন, সীমান্তে সহিংসতা কোন মতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এর জন্য দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা উচিত। আমি এ সহিংসতার অবসান চাই। অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ভারত বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য একটি ভাল অবলম্বন হতে পারে। কারণ, ভারতের বাজার অনেক বড়। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে খুবই দক্ষতার সঙ্গে সহযোগিতা করছে বলেও মন্তব্য করেন মজিনা। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি প্রসঙ্গে মজিনা বলেন, প্রেসিডেন্ট ওবামা বলেছেন- চীন আমাদের শত্রু নয়, বন্ধু। অনুষ্ঠানে উপস্থিত চীনের রাষ্ট্রদূতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে মজিনা বলেন, আমার মনে হয় এখানে উপস্থিত চীনের রাষ্ট্রদূতও এ কথা স্বীকার করবেন। এক প্রশ্নের জবাবে মর্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ঢাকা চমৎকারভাবে পরিবর্তন হয়েছে, ১০ বছর আগে যখন আমি ছেড়ে যাই সে সময়ের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকায় কয়েক বছর আগে থেকে যাওয়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে মজিনা বলেন, আমি ঢাকার সিএনজি খুব ভালবাসি। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে মজিনা বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এ দেশের তরুণ প্রজন্মকে সহযোগিতা করতে চায়। বাংলাদেশ ইয়ুথ লিডারশিপ সেন্টারকে এজন্য যুক্তরাষ্ট্র সহযোগিতা করছে। তরুণরা বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে বলে আশা করেন তিনি। অনুষ্ঠানে উন্মুক্ত সেশনে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম, রাজনীতিবিদ ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন, কলামনিস্ট জগলুল আহমেদ চৌধূরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত আশফাকুর রহমান, রাজনীতিবিদ জহির উদ্দিন স্বপন, শিক্ষাবিদ হাসনা মওদুদ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।