প্রভাবশালী ব্রিটিশ সাময়িকী ইকোনমিস্ট তাদের সর্বশেষ সংস্করণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছেন মন্তব্য করে তাকে দমাতে নয়া দিল্লিকে হস্তক্ষেপ করার পরামর্শ দিয়েছে।
লন্ডনভিত্তিক সাময়িকীটি এর আগে দিল্লি থেকে আসা বস্তাভর্তি টাকায় আওয়ামী লীগের নির্বাচন জেতার কথা লিখে সমালোচিত হয়েছিল। সে সময় সরকার এর প্রতিবাদও জানিয়েছিল। এর পর আবারও সমালোচনামূখর দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।
ইকোনমিস্টের এবারের প্রতিবেদনে আগের প্রতিবেদনগুলোর মতো আবারও সরকারের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে। নতুন দুটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে ‘ধ্বংসের’ পথে নিয়ে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকার হেনস্থা করছে বলেও বরাবরের মতোই মন্তব্য করেছে পত্রিকাটি। বিরোধী দলের রাজনীতির ওপর সরকারের ‘দমনপীড়নের’ কড়া সমালোচনাও আছে রিপোর্ট দুটিতে।
ইকোনমিস্টের ২৬ মে সংস্করণে ‘লিডারস’ ও ‘এশিয়া’ বিভাগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদনই শুক্রবার সাময়িকীটির ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে।
‘পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ: ব্যাংগড অ্যাবাউট’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেশকে ‘বিপজ্জনক পথে’ নিয়ে যাচ্ছেন। আর ‘বাংলাদেশস টক্সিক পলিটিক্স: হ্যালো দিল্লি’ প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে প্রধানমন্ত্রীকে ঠেকাতে ভারতকে পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
‘হ্যালো দিল্লি’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, “শেখ হাসিনা সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তার ক্ষমতা জোরদার করতে এবং তার শত্রুদের ঘায়েল করতে ব্যবহার করছেন।”
বাংলাদেশের এই পরিস্থিতে ভারতের নাক গলানোর যুক্তি তুলে ধরতে বলা হয়, “বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা যখন জনগণের ভাগ্য নিয়ে কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না, তখন বাইরের কাউকেই এগিয়ে আসতে হবে।”
“এখন ঢাকার ওপর প্রভাব আছে ভারতের। ভারত তার নিকটতম প্রতিবেশী দেশে কার্যকর গণতন্ত্র চাইলে এখনই সময় জোর গলায় মতামত জানানোর।”
দুটি প্রতিবেদনেই বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর ‘নিখোঁজ’ হওয়া, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো, গ্রামীন ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সরকারের পদে পদে হেনস্তা করার চেষ্টার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, “ইইউ প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ সফর করে যাওয়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ইউনূসের পক্ষে দাড়ানোর পরও সরকার গ্রামীন ব্যাংককে ধ্বংসের জন্য কাজ করে যাচ্ছে।”
“ইউনূসকে হাসিনা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করছেন। এমনকি হিলারি ইউনূসের পাশে দাড়ানোর পর পরই সরকারের মন্ত্রীরা তার বিষেদগার করেছেন। সরকার গ্রামীন ব্যাংক নিয়ে আবারও আরেকটি তদন্ত শুরু করেছে।”
‘ব্যাংগড অ্যাবাউট’ প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি কূটনীতিককে গুলি করে হত্যা, ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে নির্যাতন করে হত্যা, দুর্নীতি নিয়ে অনুসন্ধান করায় সাংবাদিক দম্পত্তিকে নৃশংসভাবে হত্যা-গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে রহস্যজনক বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড হয়েছে।
জানুয়ারিতে ‘অদ্ভুত’ এক সামরিক অভ্যুত্থান চেষ্টার সুযোগে সরকার সেনাবাহিনীর ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও জোরদার করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, আগামী নির্বাচনের ১৮ মাস আগে বাংলাদেশের রাজপথ এখন উত্তপ্ত। এর মধ্যেই মানুষের জীবন খাদ্য ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, লোডশেডিং আর বেহাল সড়কে পর্যুদস্ত।
এ পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের দীর্ঘ দিনের মিত্র ভারত এখন বিএনপির দিকেও ঝুকছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে তাকে দিল্লি সফরের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। খালেদা জিয়াও ভারতকে “বন্ধু’ বলে সম্বোধন করে তার ভারতবিদ্বেষী অবস্থান বদলাতে চাইছেন।
প্রতিবেদনের ভাষ্য অনুযায়ী এত সব সংকটের পরও বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো অবস্থায় আছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান বাড়ছে। প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপর ধরে রাখা গেলে বাংলাদেশ এক দশকের মধ্যেই মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কথা ভাবতে পারবে। কিন্তু এসবের মধ্যে বাধা হিসেবে ইকোনমিস্ট দেখেছে দেশটির ‘চালককে’।
“ঢাকার অসহনীয় রাস্তার মতো রাজনীতিতেও জট লেগে গেছে। আগামী নির্বাচনের ওপর কালো ছায়া পড়ছে। কুটনীতিক ও বিদেশি পর্যবেক্ষকদের উদ্বিগ্ন দেখে বোঝা যাচ্ছে, সামনে কঠিন সময় আসছে। আর এতে সবচেয়ে বেশি দোষ দিতে হয় চালককে।”
আগেও ইকোনমিস্ট
গত বছরের জুলাইতে একটি প্রতিবেদন নিয়ে ঢাকার সমালোচনায় পড়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে আগস্টে আরো দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে ইকোনমিস্ট। তিনটি প্রতিবেদনেই শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করা হয়েছে।
গত ৩০ জুলাই ইকোনমিস্টে প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ: এম্ব্রেস্যাবল ইউ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূরাজনৈতিক স্বার্থে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইছে ভারত, যার প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ সরকার।
এর পর প্রভাবশালী এই ব্রিটিশ সাময়িকীর ওয়েবসাইটে ১২ আগস্ট ‘পয়জনাস পলিটিক্স ইন বাংলাদেশ’ ও ‘ইন দ্য নেম অফ দ্য ফাদার’ শিরোনামে দুটি প্রতিবেদনে ঘুরেফিরে শেখ হাসিনা সরকারের সমালোচনা করে।
ইকোনমিস্ট তখনও আশঙ্কা প্রকাশ করে, নিরঙ্কুশ জনসমর্থনকে পুঁজি করে হাসিনা সরকার দলীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে।