সামপ্রতিক বছরগুলোতে যখন বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি উন্নতির দিকে যাচ্ছে তখন ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) কমে গেছে। বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক আপডেট ফর মে-২০১২’ শীর্ষক রিপোর্টে একথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০১১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল শতকরা ৬ দশমিক ৭ ভাগ। ২০১২ অর্থবছরে তা এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৬ দশমিক ৩ ভাগ। এর কারণ বহির্বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহে সীমাবদ্ধতা। ২০১২ অর্থবছরে জিডিপি শতকরা ৬ দশমিক ৩ ভাগ অর্জিত হলেও তা উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় জিডিপির (৫.৫%) তুলনায় বেশি। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার জিডিপির গড় ৬ দশমিক ৫ ভাগের তুলনায় তা অনেকটাই কম। কলকারখানায় উৎপাদন প্রক্রিয়া মজবুত ও রেমিটেন্স বৃদ্ধির মাধ্যমে গত তিন বছরে বাংলাদেশ এই গড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। পরিবহন ও অর্থনৈতিক মধ্যস্থতার ফলে এ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বিশেষ করে খাদ্যপণ্য নয় এমন পণ্যের দাম বৃদ্ধির ফলে মুদ্রাস্ফীতির চাপ আগের চেয়ে বেশি খারাপ হয়েছে। ২০১২ সালের মার্চে সার্বিক মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছেছে। এ সময়ে খাদ্যপণ্য নয় এমন পণ্যের মূল্য বেড়েছে শতকরা ১৪ ভাগ। এক বছর আগে তা ছিল শতকরা ৪ দশমিক ৩ ভাগ। বিস্তৃত অর্থনীতি ও আর্থিক নীতির কারণে এমনটা ঘটেছে। অন্যদিকে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ২০১১ সালের তুলনায় ২০১২ সালে কমেছে। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ছিল শতকরা ১৩ দশমিক ৮ ভাগ। ২০১২ সালের এপ্রিলে তা এসে দাঁড়িয়েছে শতকরা ৮ দশমিক ১ ভাগ। তবে রাজস্ব উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়া সত্ত্বেও আর্থিক ঘাটতি বেড়েছে। ২০১২ অর্থবছরের বাজেটে যে ব্যয় ধরা হয়েছিল বর্তমান ব্যয় তা ছাড়িয়ে গেছে। ভর্তুকি ও অর্থ ব্যয়ের খাত পরিবর্তনের ফলে এই অবস্থা হয়েছে। জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এক বছর আগের একই সময়ের তুলনায় সরকারের বাজেট ঘাটতি বেড়েছে আড়াই গুণের বেশি। লেনদেনের ভারসাম্যে দেখা দিয়েছে টানাপড়েন। ২০১২ অর্থবছরের জুলাই থেকে মার্চে উদ্বৃত্ত ছিল ৪৫ কোটি ৬০ লাখ ডলার। আগের বছরে একই সময়ে এই অঙ্ক ছিল ৭১ হাজার কোটি ডলার। পেট্রোলিয়াম জাত পদার্থের দ্রুত দাম বেড়ে গেছে। আর তরল জ্বালানি নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে সেই জ্বালানি সরবরাহ দেয়ার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ২০১২ সালের মার্চে রপ্তানি কমে যেতে শুরু করে। এতে লেনদেনের ভারসাম্যে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি করে থাকতে পারে। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের অনিশ্চিত ট্রেড মার্কেটের কারণে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ঝুঁকি সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের বড় দু’টি রপ্তানি বাজার হলো ইউরোপ ও আমেরিকা। কিন্তু উচ্চ বেকারত্ব, ব্যবসা ও ক্রেতার আস্থায় মন্দা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মন্দা এখনও বাংলাদেশের ওই দু’টি বাজারে বড় রকমের হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বর্তমানের মুদ্রাস্ফীতির স্তর, আর্থিক ঘাটতি এবং রিজার্ভ পরিস্থিতি। সর্বশেষ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ও আর্থিক সঙ্কটের সময় বাংলাদেশের অবস্থা যতটা ভাল ছিল সে তুলনায় এখনও আর আগের মতো নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার সঙ্গে বিদ্যুতের ঘাটতি বড় একটি ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বিদ্যুতের সার্বিক ঘাটতি বিনিয়োগ ও বিভিন্ন প্রকল্পের সমপ্রসারণকে বাধাগ্রস্ত করছে। এ সমস্যা সমাধানে কর্তৃপক্ষের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ বের করা উচত। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়, ব্যষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দ্রুত প্রবৃদ্ধি পুনঃস্থাপনের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত নীতি গ্রহণ। কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি ও সরকারের ঋণ ধারণ করার জন্য প্রয়োজন স্থিতিশীল নীতি। সঞ্চয় বাড়ানো ও বিনিয়োগের হার বাড়ানো, বাণিজ্যিক সুবিধা উন্নত করা, লেনদেনের ভারসাম্য নিশ্চিত করে তা স্থিতিশীল করার মাধ্যমে অবকাঠামোর সংস্কার দ্রুত করার ওপর নির্ভর করে দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি। অবকাঠামো খাতে বড় ধরনের ঘাটতির প্রেক্ষিতে দরকার ট্যাক্স খাতকে আধুনিকায়ন করা, সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনাকে শক্তিশালী করা এবং ট্যাক্সের রাজস্ব বৃদ্ধি করা। প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করতে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন দক্ষতার অভাবকে চিহ্নিত করা, কলকারখানার চলমান উৎপাদন ও রপ্তানি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা। ওই রিপোর্টের শেষে বলা হয়, শেষ কথা হলো- অভ্যন্তরীণ ও বিদেশী বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য প্রয়োজন হবে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করা এবং বাণিজ্য বিষয়ক সংস্কার সাধন করা। বিশেষ করে প্রবৃদ্ধি দ্রুততর করার জন্য তা অতীব জরুরি।