ঢাকা, ৩ জুন: টিইআইবি’র অনুষ্ঠানে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের ঢালাওভাবে ‘চোর ডাকাত’র সঙ্গে তুলনা করায় রোববার সংসদে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সংসদ সদস্যরা। তারা এই মন্তব্যকে সংসদ ও সংবিধান অবমাননা আখ্যায়িত করে সংসদ ও সংবিধান এবং গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে সংসদে ডেকে আনা ও তার বিরুদ্ধে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপনের আহবান জানান।
পাশাপাশি অধ্যাপক আবু সায়ীদকে এই মন্তব্যের জন্য ক্ষমা চাওয়ারও আহবান জানান।
সংসদ সদস্যদেরকে ‘চোর ডাকাত’র সাথে তুলনার এই খবরটি রোববার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
সন্ধ্যায় ৭১ বিধিতে আনিত নোটিশের আলোচনার পরই স্বতন্ত্র সদস্য মো: ফজলুল আজিম প্রসঙ্গেটি উত্থাপর করে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এরপর জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলূল করিম সেলিম এ নিয়ে কথা বলেন।
মোহাম্মদ ফজলুল আজিম বলেন, “ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)’র এক আলোচনা সভায় অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ দায়িত্ব জ্ঞানহীন বক্তব্য রেখেছেন। এতে সংসদ সদস্যদের মর্যাদা ক্ষুন্ন হয়েছে। এবং তার এই বক্তব্য সার্বভৌমত্বের লংঘন। তার কাছে এটা কাম্য নয়। তার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের জন্যই কাম্য নয়। আমরা যারা সংসদে আসি তারা জনগণের রায় নিয়ে আসি। এখানে আমরা অনেকেই আছি যারা বার বার নির্বাচিত হয়ে সংসদে আসি।”
তিনি বলেন, “নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। সমালোচনা করুন। কিন্তু ঢালাওভাবে সংসদ সদস্যদের হেয় করা সংবিধান এবং সংসদ অবমাননার শামিল। আমাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। আমরা যদি নির্বাচিত হয়ে বেআইনি কাজ করি তাহলে আগামী নির্বাচনে জনগণ আমাদের প্রত্যাখ্যান করবে। অতীতে এর বহু রেকর্ড আছে।”
তিনি বলেন, ”উনাকে সম্মান করি। কিন্তু এ ধরনের মন্তব্য মোটেই কাম্য নয়। এজন্য গণতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
মুজিবুর রহমান চুন্নু বলেন, অধ্যাপক আবু সায়ীদ শনিবার টিআইবির একটি অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ইতিহাস হলো এদেশের জন্য মানুষের জন্য যত বড় বড় কাজ সবই রাজনীতিবিদরাই করেছেন। এদেশের মানুষের মুক্তির জন্য রাজনীতিবিদরাই সব চেয়ে বড় আত্মত্যাগ করেছেন।
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, “যিনি দেশের জন্য কিছু করতে পারেন না তিনি দেশের মানুষের দায়িত্ব নিতে পারেন না। তিনি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। আমাদের সংসদ সদস্যদের মধ্যে অনেকে ভালো আছে। আবার খারাপও আছে। কিন্তু উনার এধরনের ঢালাও মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করছি।”
শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, অধ্যাপক আবু সায়ীদ একজন শিক্ষক। ওই শিক্ষক যদি ছাত্রদের এভাবে পড়ান তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ কোথায় যাবে বলতে পারছি না। তার এই বক্তব্য গণতন্ত্রের ওপর আঘাত হানবে। সংসদের ওপর আঘাত এনেছে। এইসব বুদ্ধিজীবীরা কিছু কিছু সময় জাতির বিবেক হয়ে যান। কিন্তু জাতির দুর্যোগের সময় উনাদের টিকিটিও খুজে পাওয়া যায় না। দেশে যখন গণতান্ত্রিক সরকার থাকে, জনগণের প্রতিনিধি থাকে তখন এসব বুদ্ধিজীবীদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সামরিক সরকার আসে, অগণতান্ত্রিক অবৈধ সরকার আসে, তাহলে উনারা পদ পান। সুবিধা পান। টাকার মালিক হন। এদের চালচলন, জীবনযাত্রা, গাড়ি বাড়ির টাকার উৎস কোথায়? একজন শিক্ষকের তো এতো গাড়ি বাড়ি থাকার কথা না। সব টাকার উৎস সম্পর্কে তাদেরও জবাব দিতে হবে।”
সেলিম বলেন, “টিআইবি প্রশাসনের দুর্নীতি নিয়েও ঢালাওভাবে মন্তব্য করেছে। ১/১১ এর সময় দুর্নীতির কথা তো আপনারা বলেন নাই। আপনারা সার্টিফিকেট দেয়া বন্ধ করুন। এনজিও থেকে টাকা আনেন এদেশের মানুষের কল্যাণের জন্য। আর সেই টাকা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার করেন।”
শেখ সেলিম বলেন, “অর্থমন্ত্রীকে বলবো তাদের সেই টাকার উৎস খুঁজে বের করুন। তাদের জবাব দিতে হবে। আমরা সংসদ সদস্য। সংসদে জবাব দেবো।”
তিনি আরো বলেন, “তারা সংসদের ওপর আঘাত হেনেছে। সংসদ ভালোভাবে চলুক এটা তারা চায় না। মন্ত্রীদের বিরদ্ধে সুনির্দিষ্ট দুর্নীতি দেখান। অতীতেও এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ৮০ সালে আমি যখন এমপি ছিলাম তখন একজন পুলিশ অফিসার মন্ত্রী সম্পর্কে ঔদ্ধতপূর্ণ আচরণ করেছিলেন। স্পিকার তাকে সংসদের ডেকে এনে ডকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন। ওই পুলিশ অফিসার নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছিল। এ নজির আমাদের সংসদে আছে। সুতরাং বিশেষ অধিকার কমিটিতে তাকে ডাকুন। তাকে ডেকে তার ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পারেন। তথ্যভিত্তিক সদোত্তর দিতে না পারলে গণতন্ত্র, জাতীয় সংসদ এবং এদেশের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মান রক্ষার জন্য তার বিরুদ্ধে সংসদ থেকে নিন্দা প্রস্তাব আনতে পারেন।”
এ সময় স্পিকারের দায়িত্বপালনকারী প্যানেল সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, “জনগণ এদেশের মালিক। জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে সংসদ সদস্য হতে হয়। এদেশের মানুষের অধিকার রক্ষায় সংসদের ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে। অধ্যাপক সায়ীদ বলেছেন- এমপি মন্ত্রীরা চোর ডাকাতের মতো আচরণ করেন। তাদের আচরণ সঠিক নয়। তারা শপথ ভঙ্গ করেন। তার এ ধরনের মন্তব্য সংবিধানের লংঘন। সংসদকে অবমাননা করা। একই সঙ্গে তিনি গণতন্ত্রকে পদদলিত করেছেন।”
তিনি আরো বলেন, “দেশের মানুষের অধিকার আছে। জনতার আদালতে আমাদের যেতে হবে। জনগণ আমাদের মন্দ কাজের জন্য প্রত্যাখ্যান করতে পারে। সংসদকে অবমাননা করা মানে গণতন্ত্রকে পদদলিত করার অপপ্রয়াস। এটা জাতির জন্য ভালো নয়। আমি মনে করি সংসদ থেকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তার এ বক্তব্য কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বর্তমান সরকার নির্বাচিত। এটা সংবিধানের বাইরের কোনো সরকার নয়। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি বা সংসদ ছাড়া দেশের এবং সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিতিহা থাকে না।”
অধ্যাপক আলী আশরাফ বলেন, তার বক্তব্যে সংসদ সদস্যদের বিশেষ অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। আমরা তাকে একটা নোটিশ দিয়ে সংসদে তলব করতে পারি। তিনি যেই হন না কেন সার্বভৌম সংসদ অবমাননাকারীকে ছেড়ে দেয়া যাবে না। সংসদ সদস্যদের অবমাননা করা মানে জাতিকে অবমাননা করা। মুক্তিযুক্তকে অবমাননা করা।”
অধ্যাপক আলী আশরাফ আরো বলেন, “তাকে সংসদে দাঁড়িয়ে ১৬ কোটি মানুষের কাছে শর্তহীনভাবে ক্ষমা চাইতে হবে। এই সংসদ ১৬ কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে। এখানেই জাতির ভাগ্য নিয়ে আলোচনা হয়। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আজ জনগণকে এভাবে পদদলিত করা খারাপ সংকেত। তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে গণতন্ত্রের আকাশে কালো মেঘ দেখা দেবে।”
তিনি কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিশেষ অধিকার রক্ষা কমিটিতে আলোচনা করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আহবান জানান।