সাহারা পরিবারের কাছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (‘সেবি’) আইন লঙ্ঘন করে জনগণের কাছ থেকে নেয়া ২৪ হাজার কোটি টাকা ফেরত দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। আর নিয়ম ভেঙে জনগণের কাছ থেকে বিনিয়োগ সংগ্রহের জন্য ‘সেবি’র রায়ে সুব্রত রায় সাহারাকেই দায়ী করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে সাহারা পরিবার যে আপিল করেছিল তাতেও ‘সেবি’র রায় বহাল রাখা হয়। এমনকি এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্নৌ বেঞ্চ এই ঘটনার বিষয়ে সুব্রত রায় সাহারা সম্পর্কে বলেছেন, তিনি আদালতে পরিচ্ছন্ন হাতে আসেননি।
সুব্রত রায় সাহারা-এর দায়দায়িত্ব এড়াতে তাঁর আইনজীবীর মাধ্যমে যে সাফাই বিবৃতি দেন তা প্রত্যাখান করেছে ‘সেবি’। বর্তমানে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ বছরে ১৫ ভাগ সুদে প্রত্যেককে পে অর্ডারের মাধ্যমে ফেরত দেয়ার নির্দেশটি কার্যকর হতে পারছে না। কারণ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট বিষয়টি আংশিক স্থগিত রেখেছে। আশা করা হচ্ছে শিগগিরই এর শুনানি হবে।
ভারতের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক ও ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০০৮ সাল থেকে সাহারা ইন্ডিয়া রিয়েল এস্টেট কর্পোরেশন লিমিটেড (সিরেকল) এবং ২০০৯ সাল থেকে সাহারা হাউজিং ইনভেস্টমেন্ট (এসএইচআই) উপযুক্ত কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই জনগণের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ শুরু করে। কিন্তু ‘সেবি’র কাছে অভিযোগ আসে, সাহারা পরিবারের দুই প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদনহীনভাবে টাকা তুলছে। জনগণের কাছ থেকে অর্থ তুলতে তারা এর নাম রেখেছিল ‘অপশনালি ফুলি কনভারটিবল ডিবেনচারস’ (ওএফসিডি)। ভারতের প্রচলিত কোনও আইনে এমন কিছু স্বীকৃত নয়। প্রাথমিক তদন্তে ‘সেবি’ অভিযোগ প্রমাণিত হলে ২০১০ সালের ২৪শে নভেম্বর সাহারার ওই দু’টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয় ‘সেবি’। পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত টাকা তোলা বন্ধ করে দেয় এবং আরও বলে যে, কোনক্রমেই এবং কোন নাম দিয়েই ওই দু’টি প্রতিষ্ঠান মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলতে পারবে না। সুব্রত রায় ‘সেবি’র ওই সিদ্ধান্তের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লক্ষ্নৌ বেঞ্চে রিট মোকদ্দমা দায়ের করেন। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ২০১০ সালের ১৩ই ডিসেম্বর ‘সেবি’র আদেশ স্থগিত ঘোষণা করে।
তবে হাইকোর্টের অন্তবর্তীকালীন আদেশে বলা হয়, ‘সেবি’ এই সময়ের মধ্যে সাহারার ওই দু’টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত কার্যক্রম চালাতে পারবে। তবে তারা সাহারা বিষয়ে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এভাবে সেবি’র আদেশ স্থগিত হলো, সাহারা আবার টাকা তোলা শুরু করতে পারলো। অবশ্য এলাহাবাদ হাইকোর্ট গত বছরের ১২ই জানুয়ারিতে এ মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানির তারিখ ধার্য করেছিল। তাই ‘সেবি’ যখন এর মাত্র ক’দিন আগে হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে, তখন সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেনি। তবে এলাহাবাদ হাইকোর্ট শেষ পর্যন্ত ৭ই এপ্রিল ২০১১ ‘সেবি’র আদেশই বহাল রেখে তাদের স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট করে দেয়। সাহারা পরিবার তখন দু’টি কাণ্ড করে। প্রথমত, তারা এর বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টে যায়। দ্বিতীয়ত, তারা এলাহাবাদ হাইকোর্টের যে বেঞ্চ স্থগিতাদেশ দেয় সেই বেঞ্চে নতুন করে আবেদন করে। এতে তারা আগের স্থগিতাদেশ পুনর্বহালের আবেদন জানায়। ২৯শে এপ্রিল ২০১১ হাইকোর্ট সাহারার নৈতিকতা নিয়ে প্রকারান্তরে প্রশ্ন তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করে রায় দেন, পরিচ্ছন্ন হাতে আদালতে আসেনি সাহারা। তাই কোর্ট তাদের পাশে দাঁড়াবে না।
এদিকে ১২ই মে ২০১১ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট চূড়ান্তভাবে সাহারার বিরুদ্ধে ‘সেবি’র হাত শক্তিশালী করেছে। সব বাধা দূর হয়। ২০শে মে ২০১১ ‘সেবি’ নোটিশ দেয় যে, কেন সুব্রত রায় সাহারা ও তার পরিবারের অপর তিন জনের বিরুদ্ধে উপযুক্ত নির্দেশনা জারি করা হবে না। উপায়ান্তর না দেখে সাহারা ‘সেবি’র নোটিশের জবাব দেয়। ৩০শে মে ২০১১ ওই দুই কোম্পানি ‘সেবি’র কাছে তাদের উত্তর পাঠায়। তবে ইতিমধ্যে তারা একটি কোম্পানির নাম বদলে ফেলে। উল্লিখিত সিরেকল-এর নাম বদলে তারা রাখে ‘সাহারা কমিউনিটি সার্ভিসেস কর্পোরেশন লি.’। ৬ ও ৮ই জুন ২০১১ সাহারা পরিবারের মনোনীত বিএম ত্রিপাঠি এবং অনুপম প্রকাশের উপস্থিতিতে আমানত তোলার বিষয়ে শুনানি হবে বলে তারিখ ধার্য হয়। এডভোকেট সুদীপ শেঠ নিবেদন পেশ করেন সাহারার পক্ষে। সেখানে সাহারা বাংলাদেশের হায় হায় কোম্পানির মতোই উদ্ভট যুক্তি পেশ করে। তারা বলেন, তারা তো জনগণের কাছ থেকে অর্থ নেননি। তাঁরা অর্থ নিয়েছেন তাদের কাছ থেকে, যারা শুধু সাহারার খাতায় নাম লিখিয়েছেন। তাই সাহারার আমানত সংগ্রহের বিষয়টি কোনভাবেই পাবলিক ইস্যু নয়।
উল্লেখ্য, ভারতের সুপ্রিমকোর্টের প্রধান বিচারপতি এস এইচ কাপাডিয়া এক শুনানিকালে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ওএফসিডি’ এই কথাটি সাহারা কোথায় পেলো? প্রচলিত আইন-কানুনে তো এটা শোনা যায় না। এই প্রশ্ন ‘সেবি’রও ছিল। শুনানিকালে জানতে চাইলে সাহারা’র আইনজীবী বলেন, এটা শেয়ার নয়, ডিবেঞ্চার নয়। এটা হলো হাইব্রিড। ১৯৫৬ সালের কোম্পানি আইনে এটা আছে। তাই ‘সেবি’র এখতিয়ারে এটা পড়ে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এখতিয়ারের মধ্যে এটা পড়ে না। এটা হলো কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। সাহারার এই যুক্তি প্রত্যাখান করে ‘সেবি’। এটা বুঝতে পেরে সাহারা সুপ্রিম কোর্টে আইন মন্ত্রণালয়কে পক্ষভুক্ত করার একটি দরখাস্ত করেছিল। কিন্তু তা নাকচ হয়ে যায়।
২৩শে জুন ২০১১ সাহারার ওই দু’টি কোম্পানিকে কার্যত অবৈধ ব্যাংকিং করার দায়ে অভিযুক্ত করে দীর্ঘ রায় প্রকাশ করেন ‘সেবি’র পূর্ণাঙ্গ সদস্য ড. কে এম আব্রাহাম। এই রায়ে ওই দু’টি কোম্পানির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে এবং গ্রাহকদের কাছ থেকে উত্তোলিত অর্থ পরিশোধ না করা পর্যন্ত ১৫ ভাগ সুদে সমুদয় টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেয়া হয়। জনগণ যাতে সহজে টাকা নিতে পারে, সেজন্য ভারতের সর্বাধিক প্রচারিত একটি ইংরেজি ও একটি হিন্দি দৈনিকের প্রত্যেকটি সংস্করণে আদেশদানের দিন থেকে ১৫ দিনের মধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। ‘সেবি’ ভবিষ্যতে ছাড়পত্র না দেয়া পর্যন্ত ভারতের কোথাও সাহারার এই দু’টি কোম্পানি সিকিউরিটি মার্কেটে ঢুকতে পারবে না।
এই রায় থেকে দেখা যায়, সুব্রত রায় সাহারা ২০শে মে ২০১১ এক হলফনামায় বলেন, আমি একজন শেয়ার হোল্ডার মাত্র। আমি এই দুই কোম্পানির পরিচালক পদে নেই। এর কোনও নির্বাহী পদে আমি নেই। এদের ব্যবস্থাপনার সঙ্গেও আমি জড়িত নই। তাই আমার উপরে ‘সেবি’র জারি করা নোটিশ আইনবহির্ভূত। এটা প্রত্যাহার করতে হবে।
‘সেবি’ তা নাকচ করেছে। ড. আব্রাহাম লিখেছেন, সুব্রত রায় শুধু সাহারা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতাই নন, এই দুই কোম্পানিতে তার শেয়ারই ৭০ ভাগ। সুতরাং ৭০ ভাগের মালিকানা নিয়ে কেউ দায় এড়াতে পারেন না। তিনি বলতে পারেন না যে, আমি কিছু জানি না। তিনিই নীতিনির্ধারক। তাঁর কথাতেই জনগণের কাছ থেকে ২০০৮-২০০৯ সাল থেকে ২৪ হাজার কোটি রুপি তোলা হয়েছে।
গত বছরের অক্টোবরে ‘সেবি’র ওই আদেশের বিরুদ্ধে সরকারের সিকিউরিটিজ আপিলাট ট্রাইবুনাল (স্যাট)-এ আপিল করে সাহারা। কিন্তু স্যাট তা প্রত্যাখান করে ‘সেবি’র অদেশমতে টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেয়। এরপর সাহারা সুপ্রিমকোর্টে আপিল করলে সেবি’র আদেশ স্থগিত করা হয়। সেই থেকে এটি শুনানির অপেক্ষায় আছে।