সংসদ রিপোর্টার: গত তিন বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাপের মধ্যে থাকা অর্থনীতি হাতে নিয়ে আজ বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিকাল ৩টায় সংসদ অধিবেশনে ২০১২-১৩ অর্থবছরের এ বাজেট ঘোষণা করা হবে। বরাবরের মতো এবারও বিরোধী দল বাজেট উত্থাপনের সময় অনুপস্থিত থাকবে। এবারের বাজেট হবে ১ লাখ ৯১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার। এতে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার কোটি টাকা। অনুন্নয়ন ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে ঘাটতি থাকবে ৪৬ হাজার ২৪ কোটি টাকা, যা জিডিপির পাঁচ শতাংশ। ভর্তুকিতে বরাদ্দ থাকছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চলতি অর্থবছরের ১১ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা স্থানান্তরিত হবে। বিদ্যুৎ, সড়ক, রেলপথ, বন্দর ও ভৌত অবকাঠামো খাতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া এ বাজেট ২৮শে জুন পাস হওয়ার কথা রয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের এটি হবে চতুর্থ বাজেট। নতুন বাজেট হবে বর্তমান সরকারের শেষ বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট। এ কারণে একদিকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রক্ষার চাপ, পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এ দুয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে তাকে। এ লক্ষ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোসহ কিছু অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিতে হবে অর্থমন্ত্রীকে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বাজেটে বড় অঙ্কের ঘাটতি পূরণে সরকারকে বিপুল ব্যাংক-ঋণ নিতে হবে। পাশাপাশি বৈদেশিক ঋণ ও অনুদানও পেতে হবে। বাজেটের চূড়ান্ত খসড়ায় অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক-ঋণ ২০ হাজার ৮০০ কোটি, ব্যাংক-বহির্ভূত ৯২৫০ কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান বাবদ ২০ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে আগামী বছর ৭৮৫৩ কোটি টাকার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করবে সরকার। বাজেটে সামগ্রিক ভর্তুকি বাড়লেও কৃষিখাতে ৫০০ কোটি কমিয়ে ৬ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করা হবে। ঘাটতি ও ভর্তুকিনির্ভর বাজেটে অর্থমন্ত্রী দেশের সব শ্রেণীর মানুষকে খুশির খবর দিতে পারবেন না। কেননা, কৃষি খাতের ভর্তুকি কমিয়ে আনায় এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের মূল্যের সমন্বয় করতে গিয়ে সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আয় বাড়াতে মোবাইল ফোনের সিম ও কলরেটের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাব থাকবে। এনবিআর ও নন-এনবিআর রাজস্ব বাড়ানোর জন্য নতুন-পুরনো সব ধরনের গাড়ি আমদানিতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হবে। দেশে উৎপাদন হয় এমন ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়ানোসহ তামাকজাত পণ্যে শুল্ক বৃদ্ধির প্রস্তাব করবেন অর্থমন্ত্রী। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। গড় মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৫ শতাংশে সীমিত রাখার পরিকল্পনা থাকছে। বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের ১ লাখ ১২ হাজার ২৫৯ কোটি। কর বহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। এনবিআরের বাইরে আয় ৪৫৬৫ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বড় ১০ মন্ত্রণালয় ও বিভাগে মোট ৪২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়া হবে, যা এডিপির ৭৮ দশমিক ৭ শতাংশ। এগুলো হলো- স্থানীয় সরকার ১০ হাজার ২২১ কোটি, বিদ্যুৎ ৮১৪৫ কোটি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা ৫২৮০ কোটি, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ ৩৪৩৭ কোটি, সড়ক ৩২৪৪ কোটি, রেল ৩২১৭ কোটি, শিক্ষা ২৮৮৫ কোটি, পানিসম্পদ ২৪১৯ কোটি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ ২২৫১ কোটি এবং সেতু ১৫৭৯ কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, প্রবৃদ্ধির চলমান ধারা বজায় রাখতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে অর্থমন্ত্রীর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করছে, দ্রব্যমূল্য যাতে সহনীয় থাকে সে ব্যবস্থা নেয়ার। অধিক কর্মসংস্থানের জন্য ব্যবসায়ীরা চান বিনিয়োগবান্ধব বাজেট। এবারের বাজেটে অগ্রাধিকার পাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্টসহ অবকাঠামো খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা করার চেষ্টাও থাকছে। গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে শিক্ষা, কৃষি, মানবসম্পদ উন্নয়নকে। বাড়ছে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতা। কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে বরাবরের মতো এবারও ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে। রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে প্রণোদনা সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব থাকছে। ভুট্টা, পোলট্রিসহ দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে নতুন করে দেয়া হচ্ছে নগদ সহায়তা। বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে দেশী শিল্পের স্বার্থ সংরক্ষণকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে নতুন বাজেটে। এ লক্ষ্যে শতভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পে ব্যবহৃত পুঁজি যন্ত্রাংশ আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্কের পরিবর্তে শূন্য শুল্কের প্রস্তাব করা হচ্ছে। থাকছে বিলাস পণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ। এদিকে নিত্যপণ্যের দাম যেন স্থিতিশীল থাকে সে জন্য চাল, ডাল, আটা, চিনিসহ অন্যান্য পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা অব্যাহত রাখা হচ্ছে। খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাড়তি ১৩ লাখ টন খাদ্যের মজুত পরিকল্পনায় থাকছে। বাড়ানো হচ্ছে গুদামের ধারণক্ষমতা। বিনামূল্যে গরিব জনগণের কাছে চাল বিতরণে অব্যাহত থাকছে বিদ্যমান ফেয়ার প্রাইস কর্মসূচি। কম দামে চাল দিতে অব্যাহত থাকছে ওএমএস। এ ছাড়া ভিজিডি-ভিজিএফ কর্মসূচিও অব্যাহত থাকছে।
বিরোধী দল থাকবে অনুপস্থিত
এদিকে বরাবরের মতো এবারের বাজেটও বর্জন করবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন প্রধান বিরোধী জোট। মহাজোট সরকারের তিনটি বাজেট উত্থাপনের দিন অনুপস্থিত থেকেছে বিরোধী দল। গতকাল বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে তারা এবারও বাজেট উত্থাপনের দিন অনুপস্থিত থাকছেন।
অর্থমন্ত্রীর ষষ্ঠ বাজেট উত্থাপন
এদিকে আজ ষষ্ঠ বারের মতো বাজেট পেশ করতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বর্তমান সরকারের চারটি বাজেটের পাশাপাশি তিনি ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরে দু’টি বাজেট পেশ করেছিলেন। ওই সময় সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি ওই বাজেট পেশ করেন।
বাজেট অনুমোদনে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক আজ
আগামী ২০১২-২০১৩ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট, অর্থবিল-২০১২ ও চলতি অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট অনুমোদন দিতে আজ বৈঠক করবে মন্ত্রিপরিষদ। সংসদ ভবনে দ্বিতীয় লেভেলের ক্যাবিনেট কক্ষে দুপুর একটায় এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এতে সভাপতিত্ব করবেন। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকের পরে প্রেসিডেন্টের সম্মতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সংসদে বাজেট পেশ করবেন।
সংসদ সচিবালয়ের প্রস্তুতি
এদিকে বাজেটকে কেন্দ্র করে সংসদ সচিবালয়ের প্রস্তুতি নেয়া শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে আমন্ত্রিত অতিথিদের আসন বণ্টনের কাজ শেষ হয়েছে। এজন্য অধিবেশন কক্ষে বসানো হয়েছে জায়ান্ট স্ক্রিন। এছাড়া রয়েছে বড় কয়েকটি টেলিভিশন। বাজেটকে কেন্দ্র করে সংসদ সচিবালয়ে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। গতকাল থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা সংসদ সচিবালয়ের প্রতিটি কক্ষ তল্লাশি করে। একই সঙ্গে সংসদ সচিবালয়ের বাইরে নেয়া হয় বাড়তি নিরাপত্তা। সচিবালয়ের সব প্রবেশপথে অতিথিদের তল্লাশি করা হয়।
মহাজোট সরকারের তিন বাজেট
এর আগে মহাজোট সরকার তিনটি বাজেট পাস করে। ২০১১ সালের ৯ই জুন সংসদে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সরকারের তৃতীয় বাজেট (২০১১-১২ অর্থবছর) উত্থাপন করেন। এর পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। মহাজোট সরকারের দ্বিতীয় বাজেটের (২০১০-১১ অর্থবছর) আকার নির্ধারণ করা হয় এক লাখ ৩২ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের প্রথম বাজেট (২০০৯-১০ অর্থবছর) ছিল ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫৯ কোটি ৯৬ লাখ ৬৯ হাজার টাকার। ওই বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয় অর্থ বিভাগকে। আর প্রেসিডেন্টের কার্যালয়কে দেয়া হয় সবচেয়ে কম বরাদ্দ।