মিরাজ নিখোঁজ হওয়ার আগে তার প্রেমিকার কাছে ৪০ বার ফোন করেছিল। ফরিদপুর গ্রাসরুট টেক্সটাইল কলেজের ৪র্থ বর্ষের ফার্স্ট বয় মনিরুজ্জামান মিরাজ মুন্সীর রহস্যজনক মৃত্যুর পর এসব তথ্য বেরিয়ে আসছে। অভিযোগ উঠেছে, তামান্না নামের সদ্য এইচএসসি পাস এক মেয়ের প্রেমে পাগলপারা মিরাজকে কোনভাবেই ফেরাতে না পেরে ক্ষিপ্ত ছিল ওই মেয়ের পিতা ও তার পরিবারের সদস্যরা।
গত শুক্রবার রাতে ফরিদপুর শহরের আলীপুরের ছাত্র মেস থেকে হঠাৎ নিখোঁজ হয় মিরাজ মুন্সী। পর দিন সন্ধ্যায় সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে রেল লাইনের ওপর থেকে তার দ্বিখণ্ডিত লাশ উদ্ধার করে জিআরপি থানা পুলিশ। গতকাল সকালে নিহতের লাশ ফরিদপুরের ভাঙা উপজেলার পুখুরিয়া এলাকার হরূপদিয়া গ্রামের বাড়িতে নেয়া হলে কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বজনেরা। সেখানে সকাল ১০ টায় জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
পরিবারে তিন ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মুনিরুজ্জামান মিরাজ মুন্সী ছিল সবার ছোট ও আদরের এবং মেধাবীও। নিহতের পরিবার সদস্যরা মনে করেন, মিরাজকে অপহরণ ও হত্যা করে ঘটনা ধামাচাপা দিতেই সুদূর সিলেটে নিয়ে তার লাশ রেল লাইনে ফেলে রাখা হয়। গত রোববার মিরাজের মেজো ভাই আনোয়ার হোসেন আলীপুরের মেস থেকে তার বিছানা-পত্র, ল্যাপটপ ও অন্যান্য জিনিস নিয়ে যান। আনোয়ার সন্দেহ প্রকাশ করেন, মিরাজের ব্যবহৃত ল্যাপটপে তার হত্যা রহস্য উদঘাটনের মতো তথ্য বা ছবি থাকতে পারে।
ছাত্র-মেসে মিরাজ মুন্সীর রুমমেটদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিরাজ খুবই নম্র-ভদ্র নামাজি ও অত্যন্ত মেধাবী এক ছাত্র ছিল। সে সকলের জুনিয়র হওয়ায় সম্মান বজায় রেখে চলতো। তার কোন শত্রু থাকার কথা নয়। তবে তারই এলাকার তামান্না নামে এক মেয়ের সঙ্গে মিরাজের গভীর প্রেমের কথা তারা জানতো। তাদের সে প্রেম সমপ্রতি বিয়ে পর্যন্ত গড়িয়েছিল বলে তারা জানতে পেরেছে। এ সম্পর্কের বিষয়ে মেয়ের মা কিছুটা নমনীয় থাকলেও মেয়ের পিতা কেএম আমানউল্লাহ কখনও তা মেনে নেননি। আলাপচারিতায় মিরাজ এসব তাদের জানিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ইদানীং মানসিকভাবে খুব ভেঙে পড়েছিল মিরাজ। তবে লুকিয়ে-ছাপিয়ে তাদের দু’জনের দেখা-সাক্ষাৎ চলছিল নিয়মিত। মেসমেটরা আরও জানায়, তামান্নাদের বাড়ি মিরাজদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম ফাজিলপুরে। তার পিতা ভাঙ্গা উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মচারী কেএম আমানউল্লাহ। ফরিদপুর শহরের পূর্ব খাবাসপুরের শান্তিবাগের ভাড়া বাসায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে থেকে পার্শ্ববর্তী ফরিদপুর সারদা সুন্দরী কলেজ থেকে এবার সদ্য এইচএসসি পাস করেছে তামান্না।
মেসমেটরা জানিয়েছে, মোবাইল ফোনে মেয়েটির সঙ্গে লাগাতার কথা বলতো মিরাজ। মেয়েটি মিরাজের খোঁজে ওই ছাত্র মেসে অনেকবার এসে দেখা করেছে। মিরাজের ব্যবহৃত একটি ডায়েরির প্রায় সবগুলো পাতা জুড়েও এসবের দিন-তারিখ উল্লেখ করে লেখা রয়েছে। সেখানে মিরাজের স্বাক্ষর ছাড়াও তামান্নার যৌথ স্বাক্ষর দেখা যায়। নিখোঁজ হওয়ার আগে সে তার প্রেমিকা তামান্নাকে ৪০ বার ফোন করেছিল বলেও উল্লেখ আছে।
মিরাজের মেজো বোন রেশমা জানান, গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালে পার্শ্ববর্তী ফাজিলপুর গ্রামের তামান্না নামের এক সহপাঠীর সঙ্গে মিরাজের গভীর সখ্যের কথা তারা জানতো। পরে তামান্নার পরিবার তাকে অন্যত্র নিয়ে ভর্তি করে। কিছুদিন আগে ফরিদপুর শহরের সেন্ট্রাল হাসপাতালে ছোট বোন রোকসানার সদ্যজাত সন্তান দেখতে মিরাজের সঙ্গে তামান্নাও আসে। এ সময় তামান্না খুশি হয়ে নবজাতকের হাতে এক শ’ টাকাও ধরিয়ে দেয়।
নিহতের পরিবার সূত্র আরও জানায়, শুক্রবার রাতে মিরাজ নিখোঁজ হওয়ার পর শনিবার বিকালে তার বড় ভাই মাইনউদ্দীন বাসায় মিরাজের খোঁজে যান। ওই সময় তামান্নার পিতা আমানউল্লাহ তার সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দেন। মিরাজের পরিবার সদস্যদের আশঙ্কা, তামান্নার পরিবার বিশেষ করে তার পিতা মিরাজের এ রহস্যজনক নিখোঁজ ও নিহত হওয়ার বিষয়ে জানতে পারেন। এ বিষয়ে তামান্নার পিতা ভাঙ্গা উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের কর্মচারী কেএম আমানউল্লাহর সঙ্গে তার মোবাইল ফোনে কথা হলে তিনি জানান, ভাঙ্গার প্রাইমারি স্কুল ও ব্রাহ্মণকান্দা এএস একাডেমীতে তার কন্যা তামান্না ও মিরাজ সহপাঠী ছিল। সে হিসেবে সখ্য ছিল। সেখানে সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায়ই তামান্নাকে তার নানা বাড়ির এলাকায় মধুখালী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে নিয়ে ভর্তি করানো হয়। বিষয়টি সেখানেই মিটে যায়। মিরাজ নিখোঁজ ও তার হত্যা রহস্যের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে ব্যস্ততার কথা বলে এড়িয়ে যান তিনি।