কক্সবাজার জেলা কারাগারে বিনা বিচারে প্রায় এক যুগ ধরে ৩৯ জন বার্মিজ নাগরিককে আটক রাখা কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না এবং তাদের মুক্তি দিয়ে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করা হবে না, জানতে চেয়ে সোমবার সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি রুল জারি করেছে হাই কোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ। আগামী এক মাসের মধ্যে রুলের জবাব দিতে হবে। বন্দিদের প্রায় সবাই মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী পশ্চিমাঞ্চলীয় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির।
মিয়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় দেশই এসব কারাবন্দিকে নাগরিক হিসাবে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে এদের স্বদেশে ফেরত অথবা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মাধ্যমে বিকল্প ব্যবস্থা নিতে দুই আইনজীবী আবেদন (রিট) করলে হাই কোর্ট এ রুল জারি করে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সরকারের দমনমূলক নীতি ও সংখ্যাগুরু বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিপীড়নের মুখে এসব সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর লোকেরা প্রায়ই বাংলাদেশে আশ্রয় পেতে চেষ্টা করে। সর্বশেষ গত ৩ জুন সীমান্তবর্তী আরাকান প্রদেশে নতুন করে সহিংসতা দেখা দিলে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে।
দুই আইনজীবী অ্যাডভোকেট জিয়া হাবীব আহসান ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শরীফ উদ্দিন গত ১৪ জুন সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কক্সবাজার জেলা প্রশাসন সহ সর্বমোট ১১ জনকে জবাবদাতা হিসেবে নির্দিষ্ট করে তাদের প্রতি রুল জারি করতে আদালতে আবেদনটি করেন। শুনানি শেষে আবেদনে উল্লিখিত জবাবদাতাদের প্রতি সোমবার রুল জারি করে আগামী এক মাসের মধ্যে জবাব দেয়ার আদেশ দেয় হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও মো: জাহাঙ্গীর হোসেনের যুগ্ম বেঞ্চ।
আবেদনে বলা হয়, এসব বন্দিকে একদিকে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকার নাগরিক বলে স্বীকার করেনা অন্যদিকে এদের শরণার্থী মর্যাদাও নেই। এরা রাষ্ট্রহীন নাগরিকে পরিণত হয়েছে। তীব্র অর্থনৈতিক সংকট, জনসংখ্যার ভারে জর্জরিত বাংলাদেশের ওপর এরা বাড়তি চাপ হওয়া এবং মানবিক কারণে বিষয়টির নিষ্পত্তি দরকার।
যেভাবে খোঁজ পাওয়া গেল বন্দিদের
আবেদনকারী দুই আইনজীবী মানবাধিকর সংগঠন বিএইচআরএফ’র সংগঠক। মানবাধিকার সংস্থাটি তাদের নিজস্ব কাজের অংশ হিসাবে নারী ও শিশু কারাবন্দিদের মানবাধিকার বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান চালাতে গিয়ে জানতে পারে দণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও কক্সবাজার কারাগারে প্রায় এক যুগ আটক আছে ৩৯ বিদেশি কারাবন্দি।
পরে কক্সবাজার জেলা কারাগার এর তত্ত্বাবধায়কের কাছে আবেদন করে বিএইচআরএফ। কারা তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন আবেদনের জবাবে দেয়া এক চিঠিতে বন্দিদের বিষয়টি স্বীকার করে তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করেন।
মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকান (রাখাইন) প্রদেশের এসব নাগরিক বিভিন্ন অভিযোগে বাংলাদেশের আদালতের দেয়া দণ্ড ভোগ শেষ হবার কিংবা অব্যাহতির আদেশ পাওয়া স্বত্বেও দীর্ঘদিন যাবত আটক আছে। তাদের কোনো দেশের নাগরিকত্ব বা শরণার্থী হিসেবে জাতিসংঘ ঘোষিত মর্যাদা না থাকার কারণে মুক্তি বা কোথাও পাঠানোর ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এদের মধ্যে এক নারী ও এক শিশুও রয়েছে। অনেকেই শিশু অবস্থায় কারাগারে বন্দি হয়ে বর্তমানে প্রাপ্ত বয়সে পদার্পণ করেছেন।
বিএইচআরএফ তাদের তথ্যানুসন্ধানে জানতে পারে, এসব আটক ব্যক্তির পাসপোর্ট আইন, বিদেশি নাগরিক আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ দন্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় বৃহত্তর চট্টগ্রামের বিভিন্ন থানায় গ্রেফতার হয়। মিয়ানমারের বাংলাদেশ আকিয়াব, কেনডন, ইয়াংগুন প্রভৃতি অঞ্চলে বাসিন্দা হিসেবে এদের সুষ্পষ্ট নাম ঠিকানা থাকা স্বত্বেও দেশটির সরকার তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করছে। ফলে কারা কর্তৃপক্ষ তাদের মুক্তির ব্যবস্থা করতে পারছে না, অন্যদিকে এদের শরণার্থী মর্যাদা আদায়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো উদ্যোগ নেই।
এ বন্দিদের মধ্যে অন্যতম সুলতান আহমদ (২৩), পিতা মৃত এয়াকুব আলি, গ্রাম: জুপরাং, থানা: বুথিডং, জেলা: কেন্ডন। তিনি বান্দরবান জেলায় জি.আর ১১/৯৮ মামলায় ২৮/০৪/১৯৯৯ তারিখে গ্রেফতার হয়ে লামা থানা ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত কর্তৃক ১৯৪৭ সালের বিদেশি আইন এর ১৪ ধারায় ৫০০ টাকা জরিমানা ও ছয় মাসের কারাদণ্ড পান। ২৬ এপ্রিল ৯৯ ইং তারিখ থেকে সাজা ভোগ করে ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ তারিখে তার মুক্তি পাওয়ার কথা। অথচ ০৯/৯/৯৯ থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর বা একযুগেরও বেশি সময় কারাভোগ করতে হচ্ছে তাকে।
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকান প্রদেশের রাজধানী আকিয়াব অঞ্চলের মংডু থানাধীন মায়াদি গ্রামের আবুল হোসাইনের পুত্র হাফেজ আহমদ (২১) এর সাজার মেয়াদ ১৮/৭/০১ তারিখ শেষ হয়। তিনি পাসপোর্ট আইনের ৩(৩) ধারায় ৩ মাসের কারাদন্ড ভোগ করার পরও আজ পর্যন্ত প্রায় ১০ বছর যাবত কারাভোগ করে আসছেন।
কারাবন্দি মো: জালাল (৩০), পিতা: উলা মিয়া ৩১/১০/০৫ইং তারিখ মুক্তি পাওয়ার কথা, একইভাবে আবদুর রহিম (৩৮), পিতা: খলিলুর রহমান ২২/০৬/০৬ইং, মোহাম্মদ ইউছুফ আলি (৩৮), পিতা: কালা মিয়া ৩১/০৭/০৭ইং, বশির আহমদ (৩৪), পিতা: মৃত ছৈয়দ করিম এর ৩০/০৬/০৮ইং, নুর আলম (৩০), পিতা: মরহুম আব্দুর রহমান ২৪/০৬/০৭ইং, শাহ মিয়া (১৫), পিতা: মৃত জালাল আহমদ ২৪/০৬/০৭ইং, আবুল হাশিম (২৫), পিতা: মৃত কাশিম ৩০/০৬/০৮ইং, মোহাম্মদ রফিক (২২), পিতা: ছরি হোছাইন ৩০/০৬/০৮ইং, মোহাম্মদ হোছাইন (২৩), পিতা: মৃত হামেদ হাছান ৩০/০৬/০৮ ইং, টিং অং (৪৬) পিতা: ট্যাং চংক ১৮/১২/০৭ইং, লা-লো (৪৬), পিতা: মৃত তাচেং ১৫/০৮/০৮ইং, মং তোয়া অং রাখাইন (২৯), পিতা: মৃত শত্রু রাখাইন ২৯/৭/০৮ইং, আনোয়ার ইসলাম (৩৪) পিতা: কালা পুতু ৩০/০৯/০৯ইং, কিয়ং গাফ রাখাইন (২৬), পিতা: চৌং রাখাইন ০৮/০১/০৮ইং, মোহাম্মদ সেলিম (২০), পিতা: আবুল জাফর ২৮/০৬/১০ইং, আলি আকবর (২০), পিতা: মৃত ইউছুপ আলি ২৬/০৩/০৫ইং, আবু তৈয়ব (২৭), পিতা: মৃত আবু বক্কর ২৮/০৬/১০ইং, সোনা মিয়া (৩৫) পিতা: আব্দুল হোছাইন ২৮/০৬/১০ইং, আবুল কালাম (৩৩), পিতা: আমান উল্যা ২৮/০৬/১০ইং, নুর ইসলাম (২৮), পিতা: আবুল হাশেম ২৮/০৬/১০ইং, মোহাম্মদ রফিক (২৯), পিতা: মো: ওয়ায়িছ ২৮/০৬/১০ইং, মো: শুভ আলম (২৬), পিতা: বদি আলম ২৮/০৬/১০ইং, রহমত আলি (২৬), পিতা: মো: মনির আলম ২৮/০৬/১০ইং, নুর মোস্তফা (২৫), পিতা: আনু মিয়া, ২৮/০৬/১০ইং, মো: রফিক (২৭), পিতা: ছৈয়দ আলম, ২৮/০৬/১০ইং, আবুল হোছাইন (২৭), পিতা: কালামিয়া ২৮/০৬/১০ইং, চাই চাই মার্মা (৪০), ১৯/১১/০৯ইং, রশিদ উল্লাহ (২৭) ২৭/০১/১০ইং, আমান উল্লা (২৫) ২৭/০১/১০ইং, আরাফাত উল্লাহ (২৫) ২৭/০১/১০ইং, মোহাম্মদ সেলিম (৩২) ২৬/০৫/১১ইং, আজগর হোছাইন (৪৫) ২০/০৪/১১ইং, লেদু মিয়া (৪৮) ২০/০৪/১১ইং এবং নারী বন্দি সায়েদা ওয়াই-এর (২০) গত ০৩/০৮/২০১০ ইং তারিখে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। চট্টগ্রাম মেট্টোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত (ডবলমুরিং থানার সাধারণ ডায়েরি নম্বর ৪০৩, ০৮/০৬/২০০৯) এই নারীকে ০৮/০৮/২০১০ তারিখে মুক্তির আদেশ দিলেও আজও মুক্তি মেলেনি তার। একইভাবে উপলা খুমি (২৭), ০১/১১/১০ইং ও হাই ট্যোং (৪৫) পিতা: লেই চ্যুং-এর ১০/০২/১০ তারিখে মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ।