মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানির নামে অবৈধ ব্যাংকিং, প্রতারণা, মানিলন্ডারিংসহ দুর্নীতি ও অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে আইন করা হচ্ছে। বৈধভাবে এমএলএম ব্যবসার জন্য সরকারের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে লাইসেন্স নিতে হবে। পণ্য ও সেবার বাস্তব উপস্থিতি ছাড়া কল্পিত সেবা ও পণ্যের ওপর বিনিয়োগ করা যাবে না। লাইসেন্স ছাড়া কার্যক্রম পরিচালনার জন্য শাস্তি হবে ৩ বছরের কারাদণ্ডসহ অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। প্রস্তাবিত ডাইরেক্ট সেল আইন ২০১১-এ এসব বিধান রাখা হয়েছে। জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনেই খসড়া আইন পাস করা হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ৭০টি এমএলএম কোম্পানি রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই অবৈধ ব্যাংকিং, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ, মানিলন্ডারিং, মোটা অঙ্কের লাভের প্রলোভন দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করা, কল্পিত পণ্য দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা ওঠানোর অভিযোগ রয়েছে। ডেসটিনি গ্রুপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড অবৈধভাবে ২৫০ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। এর বেশির ভাগ টাকাই প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা সরিয়ে নিয়েছেন। এইমওয়ে কর্তৃপক্ষ অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় ৫শ’ কোটি টাকা সংগ্রহ করেছে। ২১০ কোটি টাকা সংগ্রহের পর ডোলেন্সার নামক কোম্পানির এমডি রুকুনুজ্জামান ২২শে জুন রাতে উধাও হয়েছেন। ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লি.-এর বিরুদ্ধে গ্রাহকদের কাছ থেকে ৫০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে মামলা করা হয়েছে। অবৈধভাবে ১৪০০ কোটি টাকা সংগ্রহ, হস্তান্তর ও গোপন করার অভিযোগে ইউনিপে টু ইউ’র ৬ কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে মানিলন্ডারিং আইনে দুদক চার্জশিট দাখিল করেছে। ইউনিগেট টু ইউ’র এমডিসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে ৮০ কোটি টাকা অবৈধভাবে সংগ্রহের অভিযোগে দুদক চার্জশিট দিয়েছে।
এ অবস্থার অবসানে সরকার এমএলএম কোম্পানিগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। খসড়া আইন শিগগিরই মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেনের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের টিম খসড়া আইনটি প্রণয়ন করেছে। বাণিজ্য সচিব গোলাম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, আইনটি ডাইরেক্ট সেল ব্যবসা ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্রেতা, পরিবেশক, ভোক্তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। আইনের আওতায় এমএলএম কোম্পানিসমূহ নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি পরিদপ্তর থাকবে। এই পরিদপ্তরে নিয়ন্ত্রক, উপ-নিয়ন্ত্রক, সহকারী নিয়ন্ত্রকসহ প্রয়োজনীয় জনবল থাকবে। এ আইনে সব অপরাধ জামিন অযোগ্য, আমলযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে।
খসড়া আইনে কল্পিত পণ্যের ওপর বিনিয়োগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুমোদিত পণ্যের মধ্যে থাকছে বিনিময়যোগ্য দলিল, শেয়ার, ঋণপত্র, মুদ্রা, যে কোন অস্থাবর বাণিজ্যিক সামগ্রী। ডাইরেক্ট সেল বলতে এরূপ বিপণন কার্যক্রম বলতে ‘যে ক্ষেত্রে কোন পণ্য বা সেবা বিক্রি, বণ্টন, স্বত্ব, এজেন্সি বা লাইসেন্সপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি ওই পণ্য বা সেবা বিক্রি বা বণ্টনের জন্য কমিশন, লভ্যাংশ, মুনাফা, আর্থিক বা অনার্থিক কোন সুবিধা প্রদানের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে নিজ স্বত্ব বা লাইসেন্সের আওতায় বিপণনকর্মী নিয়োগ বা স্বত্বসহ বিপণনকারী হিসেবে নিয়োগ করেন বোঝাবে।’ বহু স্তর বিপণন, পিরামিড সদৃশ বিপণন কার্যক্রম, নেটওয়ার্ক, টেলি মার্কেটিং, ডোর টু ডোর সেল, মেইল অর্ডার সেল ও ই-মার্কেটিং ডাইরেক্ট সেলের আওতায় আসবে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, পরিদপ্তরের প্রধান কার্যালয় থাকবে ঢাকা শহরে। বিভাগ বা প্রশাসনিক ইউনিটেও পরিদপ্তরের কার্যালয় স্থাপন করা যাবে। ডাইরেক্ট সেল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্সের কার্যকারিতা স্থগিত, বাতিল, পুনর্বহালের ক্ষমতা থাকবে পরিদপ্তরের। জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রারের কাছ থেকে ছাড়পত্র ছাড়া লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যাবে না। যেসব পণ্য, সেবা বিপণন করা হবে সে সবের নামসহ বিস্তারিত বিপণন পদ্ধতি ও পরিকল্পনা দেখাতে হবে। আবেদনকারী কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের সমপরিমাণ অর্থের ব্যাংক গ্যারান্টি দাখিল করতে হবে। পণ্যের সংগ্রহ, ক্রয়, লভ্যাংশসহ বিক্রয় মূল্যের সম্ভাব্য পরিমাণ উল্লেখ করতে হবে। কোম্পানি কতটি স্তরে তার পণ্য ও সেবা বণ্টন করবে তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকতে হবে। কোম্পানিকে কোন সদস্য, ক্রেতা-পরিবেশককে প্রতারিত করবে না মর্মে লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। প্রতিটি সেবা বা পণ্যের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারিত থাকবে। ভোক্তা পর্যায়ে নির্দিষ্ট মূল্যের অতিরিক্ত অর্থ নেয়া যাবে না। টার্গেট ভিত্তিক কমিশন বা মুনাফা প্রদানের চুক্তি থাকলে টার্গেট পূরণে অসামর্থ্যের ক্ষেত্রে আনুপাতিক হারে কমিশন বা মুনাফা দিতে হবে পরিবেশক বা বিক্রেতাকে। পণ্য মোড়কবদ্ধ এবং মোড়কের গায়ে পণ্যের ওজন, পরিমাণ, উপাদান, ব্যবহারবিধি, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য, প্যাকেটবদ্ধকরণের তারিখ, ওয়ারেন্টির মেয়াদ স্পষ্টভাবে লেখা থাকতে হবে।
অলীক পণ্য, ভবিষ্যতে বিপণনযোগ্য কোন সেবা বা পণ্য বিক্রি করা যাবে না। জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকান, অফিস স্পেস, গাছ, সমবায় পদ্ধতির খামার, সমিতি, ব্যবসা, ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি ডাইরেক্ট সেলের আওতায় আসবে না। কমিশন বা বোনাস হিসেবে কোন শেয়ার বা ঋণপত্র ক্রয়-বিক্রয় করা যাবে না।
কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক লাইসেন্স ছাড়া এমএলএম কার্যক্রম চালানো, কোন বিক্রেতা পরিবেশক পণ্য, সেবা বিক্রি করলে শাস্তি হবে ন্যূনতম ২ বছর বা অনধিক ৩ বছরের কারাদণ্ডসহ অনধিক ৫০ হাজার টাকার অর্থদণ্ড। অযৌক্তিকভাবে পণ্যমূল্য নির্ধারণ করলে এবং প্রতিশ্রুত পণ্য, সেবা যথাযথভাবে সরবরাহ না করলে, চুক্তি ভঙ্গ করলে একই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। নিম্নমানের পণ্য দিয়ে ক্রেতাকে প্রতারিত করলে এবং মোড়কবিহীন পণ্য বিপণনের শাস্তি ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডসহ ৩ বছরের কারাদণ্ড। মিথ্যা বিজ্ঞাপন ও নির্ধারিত মূল্যের অতিরিক্ত মূল্যে সেবা, পণ্য বিক্রি করলে শাস্তি হবে ন্যূনতম ১ বছরের কারাদণ্ড। লাইসেন্স বাজেয়াপ্ত করার পরও কোন কোম্পানি ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখলে জড়িতদের ৫ বছরের কারাদণ্ড ও কোম্পানির সব সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করতে পারবে।
জয়েন্ট স্টক কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী দেশে প্রায় ৭০টি এমএলএম কোম্পানি রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগের বিরুদ্ধেই অবৈধ ব্যাংকিং, প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ এবং মানি লন্ডারিংসহ নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। গুরুতর অভিযোগের তালিকায় থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড, ইউনিপে টু ইউ, ইউনিগেট টু ইউ, ইউনি রুট ফাইন্যান্স অ্যান্ড কমার্স লিমিটেড, এমইএমওয়ে, বুনিয়ন ভল্ট লিমিটেড, ইজেন গ্রুপ, এইমওয়ে, ডোলেন্সার,স্কাইলান্সার,রেভোনেক্স,ইউনি রুট ফাইন্যান্স, স্টার ডিসেন্ট মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি (এসডিসিএল), ফারইস্ট ইসলাম কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড (এফআইসিএল), কনজারভেটিভ গ্রুপ, আল-ফারুক গ্রুপ, এভারগ্রিন গ্রুপ, উত্তরা গ্রুপ, অগ্রণী ইনভেস্টমেন্ট, জনতা গ্রুপ, বসুধা গ্রুপ, আল-আকসা গ্রুপ, আরসিএল গ্রুপ, শাহজালাল গ্রুপ, মাক্সিম গ্রুপ।