প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে চট্টগ্রাম নগরী ও বাঁশখালীতে নিহত হয়েছেন অন্তত নয়জন। এছাড়া দেয়াল চাপা এবং তড়িতাহত হয়ে মারা গেছেন আরো পাঁচজন।
গত কয়েকদিনের ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার ভোর থেকে প্রবল বর্ষণের মধ্যে বিকালে বিমান এবং সন্ধ্যার পর চট্টগ্রামের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ব্যাহত হচ্ছে সমুদ্র বন্দরে পণ্য খালাসও।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ৪৬২ দশমিক ৫ মিলিমিটার।
বর্ষণে বন্দরনগরীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েকটি সড়কে গাড়ি চলাচলও বন্ধ রয়েছে।
পাহাড় ধস
পাহাড় ধসে নগরীর খুলশী এলাকায় ছয়জন এবং বাঁশখালী উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নগরীর আমবাগান এবং হাটহাজারী উপজেলায় দেয়াল ধসে দুজন মারা গেছেন।
খুলশীর আকবর শাহ এলাকার ইয়াসিন কলোনিতে সন্ধ্যার পর পাহাড় ধসে চাপা পড়ে অন্তত ২০টি ঘর। গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। রেলওয়ে মালিকানাধীন ওই পাহাড়কে স্থানীয়রা কবরস্থান পাহাড় নামে চেনে।
অগ্নিনির্বাপন বাহিনী চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক জসীম উদ্দিন বার্তা৭১ডটকমকে বলেন, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে পাহাড় ধসে ২০ থেকে ২৫টি ঘর চাপা পড়ে।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে জসীম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি জানান, ঘটনাস্থল থেকে একজন পুরুষ, একজন নারী এবং একটি শিশুকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
রাত সাড়ে ৯টার দিকে সেখানে এক নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। মাটি চাপাপড়া লাশটি তুলে আনা হলে ওই এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে কান্নার রোল ওঠে।
নিহত শানু (১৬) আবু তৈয়বের ছেলে। পাহাড় ধসের সময় সে ঘরেই ছিল।
রাত সাড়ে ১২টার দিকে উর্মি (১২) নামে আরেকটি শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। উর্মির বাবার নাম মিজান।
স্থানীয়দের দাবি, মাটির নিচে চাপা পড়েছে আরো কয়েকজন। তবে উদ্ধারকর্মীরা জানায়, উদ্ধার অভিযান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না।
অগ্নিনির্বাপণ বাহিনীর কর্মীদের উদ্ধার অভিযানে সহযোগিতা করছে পুলিশ। রাত ১০টার দিকে সেনাসদস্যরা কাজে যোগ দেয়।
চট্টগ্রামের মেয়র এম মনজুর আলম, বিভাগীয় কমিশনার সিরাজুল ইসলাম খান ও জেলা প্রশাসক ফয়েজ আহমেদ উদ্ধার কাজ তদারকি করছেন।
রাত সাড়ে ৮টার দিকে খুলশীর জয়ন্তিকা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিশ্ব কলোনির হাবরাতলী এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে মারা যান চারজন।
তারা হলেন- রাবেয়া বেগম (৬০), আব্দুল খালেক (৬৫), কুলসুম আক্তার (৮) ও মাসুম (২)।
ঘটনাস্থলে উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নেওয়া অগ্নিনির্বাপন বাহিনীর কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বার্তা৭১ডটকমকে বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন ওই পাহাড়ের পাদদেশে তিন-চারটি ঘর ছিল। বর্ষণের কারণে পাহাড় ধসে পড়লে নিহতরা চাপা পড়েন।
সকালে নগরীর সুগন্ধা একুশে হাসপাতাল সংলগ্ন একটি পাহাড় এবং দুপুরে লালখান বাজার বাগঘোনা পোড়া কলোনি এলাকায় অন্য একটি পাহাড়ের কিছু অংশ ধসে পড়ে।
এতে দুই ব্যক্তি সামান্য আহত হন এবং একটি প্রাইভেটকার মাটিচাপা পড়ে। পরে অগ্নিনির্বাপন বাহিনীর কর্মীরা গাড়িটি উদ্ধার করে।
বাঁশখালী উপজেলার জঙ্গল শীলকূপ এলাকায় পাহাড় ধসে তিন সহোদরের মৃত্যু হয় বলে বাঁশখালী থানার ওসি মো. শাহজাহান খান বার্তা৭১ডটকমকে জানান।
নিহত শহীদুল (১২), খোরশেদ (৮) ও ফাতেমা (৪) ওই এলাকার মো. মিনহাজুর খানের সন্তান।
ওসি বলেন, রাত সাড়ে ৮টার দিকে পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটিতে চাপা পড়েন তিন ভাই-বোন। স্থানীয়রাই তাদের উদ্ধার করেছে।
২০০৭ সালে জুন মাসে প্রবল বর্ষণে বন্দরনগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
গত কয়েকদিনের বর্ষণের পর পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরতদের সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংও হচ্ছিল।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিশ্বকলোনি ও বাটালি হিল এলাকায় দুটি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী অর্ধশতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন।
দুটি পাহাড়ে অবৈধভাবে তৈরি করা ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি ঘরও ভেঙে দেওয়া হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ ভুইয়া বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করা অন্যান্য পরিবারগুলোকেও পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হবে। দুটি পাহাড় থেকে ২০টির মতো অবৈধ বসতঘর ভেঙে দেয়া হয়েছে।
দেয়াল ধস
সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় নগরীর দক্ষিণ আমবাগান এলাকায় দেয়াল ধসে আবুল হোসেন (৮) নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়। সে ওই এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ ফরিদ মিয়ার ছেলে।
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল মোহাম্মদ সুমন মিয়া বার্তা৭১ডটকমকে জানান, এলাকার মা ভবনের পাশে মো. ফারুকের বাড়ির দেয়ালচাপা পড়ে শিশুটি গুরুতর আহত হয়।
চমেক হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে জানান কনেস্টবল সুমন।
এছাড়া ও আর নিজাম রোড এলাকায় একটি আবাসিক ভবনের সীমানা দেওয়াল ভেঙে পড়ে বলে অগ্নিনির্বাপন বাহিনী জানায়।
হাটহাজারী থানার ওসি লিয়াকত আলী বার্তা৭১ ডটকমকে জানান, সন্ধ্যায় খোন্দকিয়া হাজিপাড়া গ্রামে দেয়াল চাপা পড়ে এ্যানী (১৫) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে।
তড়িতাহত হয়ে ৩ জনের মৃত্যু
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা এবং বন্দর থানাধীন আকমল আলী সড়কে তড়িতাহত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
বিকাল ৪টার দিকে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার ১২ নম্বর রোডে নিজ বাসায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন নুরুল ইসলাম (২৬) নামে এক যুবক। তিনি ওই এলাকার মো. আব্দুল্লাহর ছেলে।
তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন বলে বার্তা৭১ ডটকমকে ডটকমকে জানান চমেক পুলিশ ফাঁড়ির নায়েক মৃণাল চাকমা।
অন্যদিকে নগরীর বন্দর থানার আকমল আলী রোডে সন্ধ্যায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান আরো দুই ব্যক্তি। তাদের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
বন্দর থানার ওসি নুরুল আফসার ভূঁইয়া বার্তা৭১ ডটকমকে ডটকমকে বলেন, দুজনকে গুরুতর আহতবস্থায় স্থানীয় নেভি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়।
নগরীর উঁচু এলাকা জামালখান, আন্দরকিল্লা, আসকারদিঘির পাড় এলাকার বিভিন্ন ভবনের নিচ তলায়ও পানি উঠেছে।
চট্টগ্রাম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকার (ইপিজেড) বিভিন্ন কারখানার নিচ তলায় পানি ঢুকেছে। ফলে এসব কারখানার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই বিভিন্ন কারখানায় কর্মীদের ছুটি দেওয়া হয়।
চট্টগ্রামের বৃহৎ পাইকারি ব্যবসাকেন্দ্র খাতুনগঞ্জ, আছাদগঞ্জ ও কোরবানিগঞ্জের বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে ব্যবসায়িক কার্যক্রমও।
বৃষ্টির পাশাপাশি জোয়ারের পানিকে জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী করছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জলাবদ্ধতা বিষয়ক কমিটির সভাপতি ওয়ার্ড কাউন্সিলর বিজয় কুমার চৌধুরী।
তিনি বার্তা৭১ ডটকমকে বলেন, অস্বাভাবিক বৃষ্টির কারণে জলাবদ্ধতা বেশি হয়েছে। বৃষ্টির পাশাপাশি জোয়ারের পানিও ছিল।
নগরীর বিভিন্ন খাল ও নর্দমা পরিষ্কার রাখতে সিটি করপোরেশনের কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছে বলে জানান ওয়ার্ড কাউন্সিলর। এছাড়া অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে নগরীর নিচু এলাকা প্লাবিত হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।
৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্য বেশি। এজন্য উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।