প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবানে পাহাস ধসে, ঘর চাপা পড়ে এবং বজ্রপাতে অন্তত ৬৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এক সপ্তাহ ধরে টানা বৃষ্টির পর চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা কমতে শুরু করলেও বান্দরবান ও কক্সবাজারের পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। চট্টগ্রামে বিমান ওঠানামা এবং ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে মঙ্গলবার থেকে।
বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ও বাঁশখালীতে পাহাড় ধসে নিহত হয়েছেন অন্তত ১৩ জন। এছাড়া দেওয়াল চাপা এবং তড়িতাহত হয়ে মারা গেছেন আরো ৫ জন।
বান্দরবানের লামায় পাহাড় ধসে মারা গেছে ২৪ জন। আর নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় মাটির ঘর ধসে ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আর কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে, ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে, পানিতে ডুবে ও বজ্রপাতে মারা গেছে আরো ২১ জন।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় চট্টগ্রামে ৪৬২ দশমিক ৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়।
বর্ষণে বন্দরনগরীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। কয়েকটি সড়কে গাড়ি চলাচলও বন্ধ থাকে। তবে রাত ৯টার পর বৃষ্টি কমে এলে পানি সরে যেতে শুরু করে।
বান্দরবান
প্রবল বৃষ্টিতে পাহাড় ধসে বান্দরবানের লামায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়িতে মাটির ঘর ধসে নিহত হয়েছে ৬ জন।
কয়েকদিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বিভিন্ন নিচু এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বান্দরবান, রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা ও আলীকদম এবং নাইক্ষ্যংছড়ির সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
ফাইতং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শামসুল আলম বলেন, মঙ্গলবার রাতে বৃষ্টির মধ্যে একটি পাহাড় ধসে কয়েকটি বাড়ির ওপর পড়ে। এতে চার পরিবারের ১৮জনসহ অন্তত ২৪ জনের মৃত্যু হয়।
ফাইতং পুলিশ ফাঁড়ির ওসি আবু বকর বলেন, আরো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। উদ্ধার অভিযান চলছে। তবে আবহাওয়া খারাপ থাকায় কাজ এগোচ্ছে ধীর গতিতে।
তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে বলে লামার স্বাস্থ্য পরিদর্শক দিদারুল ইসলাম।
জেলা প্রশাসক বলেন, মঙ্গলবার রাত থেকে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে লামার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বাসভবন, উপজেলা পরিষদ ও বাজার এলাকায় পানি জমে গেছে। বিদ্যুৎ না থাকায় টেলিযোগাযোগও ব্যাহত হচ্ছে।
এদিকে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার বাইশারীতে মাটির ঘর ধসে শিশুসহ ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি এস এম আজাদ জানান, প্রবল বৃষ্টিতে মাটির দেওয়াল নরম হয়ে যাওয়ায় রাতে কোনো এক সময় ঘরটি ভেঙে পড়ে। পরে সেখান থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।
নিহতদের মধ্যে একটি শিশু থাকার কথা বললেও তাদের পরিচয় জানাতে পারেননি ওসি।
এদিকে পাহাড়ি ঢলের কারণে লামা পৌর এলাকা ও বাজারে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নাইক্ষ্যংছড়ির সঙ্গে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
কক্সবাজার
টানাবর্ষণের ফলে সৃষ্ট দুর্যোগে কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন স্থানে মঙ্গলবার রাতে ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে।
উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপ্পেলা রাজু নাহা জানান, উখিয়ার হলুদিয়া পালং ইউনিয়নের পাগলিরবিল এলাকায় পাহাড় ধসে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে একই পরিবারের ৪ জন রয়েছেন।
চকরিয়ার হারবাং ইউনিয়নের ভাইঙ্গা ঘোনা এলাকায় বাড়ির দেয়াল ধসে মারা গেছে একই পরিবারের ৪ জন। এদের মধ্যে দুই শিশুও রয়েছে বলে জানিয়েছেন চকরিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম।
রামু থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একে নজিবুল ইসলাম জানান, রামুতে পানিতে ডুবে ৭ জনের খবর পেয়েছেন তারা। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু তারা জানতে পারেননি।
চকরিয়া, পেকুয়া ও কুতুবদিয়া উপজেলা বজ্রপাতে আরও ৩ জন মারা গেছেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জয়নুল বারী।
বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে ও দেওয়াল ভেঙে পড়ে সোমবারও কক্সবাজারে আটজনের মৃত্যু হয়।
চট্টগ্রাম
পাহাড় ধসে নগরীর খুলশী এলাকায় দুটি স্থানে আটজন, উত্তর পাহাড়তলীতে দুইজন এবং বাঁশখালী উপজেলায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া নগরীর আমবাগান ও হাটহাজারী উপজেলায় দেওয়াল ধসে দুজন এবং চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা ও বন্দর থানাধীন আকমল আলী সড়কে তড়িতাহত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে খুলশীর জয়ন্তিকা আবাসিক এলাকা সংলগ্ন বিশ্ব কলোনির হাবরাতলী এলাকায় পাহাড় ধসে পড়লে মারা যান পাঁচজন।
এদিকে বাঁশখালী উপজেলার জঙ্গল শীলকূপ এলাকায় পাহাড় ধসে তিন সহোদরের মৃত্যু হয় বলে বাঁশখালী থানার ওসি মো. শাহজাহান খান বার্তা৭১ ডটকমকে জানান।
ওসি বলেন, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটিতে চাপা পড়েন তিন ভাই-বোন। স্থানীয়রাই তাদের লাশ উদ্ধার করেছে।
২০০৭ সালে জুন মাসে প্রবল বর্ষণে বন্দরনগরীর বিভিন্ন স্থানে পাহাড় ধসে ১২৭ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
গত কয়েকদিনের বর্ষণের পর পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাসরতদের সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংও হচ্ছিল।
সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নগরীর বিশ্বকলোনি ও বাটালি হিল এলাকায় দুটি পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাসকারী অর্ধশতাধিক পরিবারকে উচ্ছেদ করে জেলা প্রশাসন।
দুটি পাহাড়ে অবৈধভাবে তৈরি করা ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি ঘরও ভেঙে দেওয়া হয়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক গোলাম মোহাম্মদ ভুইয়া বলেন, নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাস করা অন্যান্য পরিবারগুলোকেও পর্যায়ক্রমে উচ্ছেদ করা হবে। দুটি পাহাড় থেকে ২০টির মতো অবৈধ বসতঘর ভেঙে দেয়া হয়েছে।
এদিকে নগরীর দক্ষিণ আমবাগান এলাকায় মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় দেওয়াল ধসে আবুল হোসেন (৮) নামে একটি শিশুর মৃত্যু হয়।
রাতে হাটহাজারীর খোন্দকিয়া হাজিপাড়া গ্রামে দেয়াল চাপা পড়ে এ্যানী (১৫) নামে এক কিশোরীর মৃত্যু হয় বলে হাটহাজারীর থানার ওসি লিয়াকত আলী জানান।
এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা এবং বন্দর থানাধীন আকমল আলী সড়কে তড়িতাহত হয়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে মঙ্গলবার।
৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেত
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, মৌসুমী বায়ু সক্রিয় থাকায় উত্তর বঙ্গোপসাগর এলাকায় বায়ুচাপের তারতম্য বেশি। এজন্য উত্তর বঙ্গোপসাগর ও সংলগ্ন উপকূলীয় এলাকা এবং সমুদ্র বন্দরসমূহের ওপর দিয়ে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে।
চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও মংলা সমুদ্র বন্দরকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।
উত্তর বঙ্গোপসাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে।