প্রস্তাবিত বাজেটে গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিতে উৎসে কর কমানো, ব্যক্তিগত আয়সীমা ২ লাখ টাকা করাসহ আটটি সুপারিশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব সুপারিশ তুলে ধরেন। অন্য সুপারিশের মধ্যে আছে, মোবাইল ফোনে রিচার্জের ওপর প্রস্তাবিত কর প্রত্যাহার, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ওপর মূল্য সংযোজন কর প্রয়োগ না করে তাদের জন্য টার্নওভার প্যাকেজ অব্যাহত রাখা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটানোর জন্য এই শিল্পে ৪০ লাখ টাকা পর্যন্ত যাদের ব্যবসা হয় তাদের ক্ষেত্রে সমপূর্ণ করমুক্ত রাখা, অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যের ওপর কর রেয়াত সুবিধা অব্যাহত রাখা, তথ্য প্রযুক্তি, কম্পিউটার সফটওয়ার, মোবাইল ফোনের সফটওয়ার, কম্পিউটার মনিটরে বর্তমানে ১৯ ইঞ্চি পর্যন্ত করমুক্ত সুবিধা দেয়া, গার্মেন্ট শিল্পের রপ্তানিতে উৎসেকর ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ করা এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংক আমানতধারীদের টিআইএন বাধ্যতামূলক না করা।
সংশোধনী প্রস্তাব দিয়ে সংসদ নেতা বলেছেন, সময়োপযোগী এই বাজেটে সব শ্রেণীর মানুষের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা রাখা হয়েছে। এই বাজেট বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা উন্নয়নের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবো। বাজেট বাস্তবায়নে দেশবাসীর সহযোগিতা কামনা করে তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে চাই। দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা গড়তে চাই।
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময় আমরা সরকার গঠন করেছি। মন্দার কারণে অনেক দেশ তাদের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু আমরা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পেয়েছি। গত অর্থবছরে আমরা ৬ দশমিক ৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছি। চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ ভাগ অর্জন করেছি। বছর শেষে ৭ ভাগের কাছাকাছি অর্জন করতে সক্ষম হবো। এবার আমাদের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ২ ভাগ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্বমন্দা এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করলেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে যে কাজ করছি তাদের প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হবো। তিনি বলেন, অনেকেই বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলেছেন। বিরোধীদলীয় নেত্রী সংসদে বাজেট সম্পর্কে বক্তব্য না দিয়ে হোটেলে গিয়ে বাজেট ভাবনা দিয়েছেন। সেখানে বাজেট ভাবনার চেয়ে ক্ষমতা হারানোর বেদনা বেশি ছিল। বাংলাদেশকে নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে নিয়ে আমাদের উচ্চাভিলাষ আছে। কারণ আমরা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই বাজেট প্রণয়ন করেছি। বাজেট সম্পর্কে তিনি বলেন, একটা রাজনৈতিক দল ও জোট নিয়ে ক্ষমতায় আছি। অন্য একটা সময় অন্য একটি জোট ক্ষমতায় ছিল তখনও বাজেট ঘাটতি ছিল। ৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত আমরা যে উন্নয়ন করেছিলাম তার ফল ভোগ করেছে। এরপরও তাদের বাজেট ঘাটতি বেশি ছিল। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়েও বাজেট ঘাটতি ছিল ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। সুতরাং বাজেট ঘাটতি অস্বাভাবিক কিছু না। আমরা প্রতি বছরই বাজেট ঘাটতি ধরি। এবার ধরেছি ৫ ভাগ। এটা এমন কোন বড় ব্যাপার নয়। আমাদের লক্ষ্যে আমরা এগিয়ে যেতে পারবো।
তিনি বলেন, অনেকে বলে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ আসেনি। আমাদের সাড়ে ৩ বছরে বিদেশী বিনিয়োগ বিএনপি-জামায়াতের ৫ বছরের চেয়ে বেশি হয়েছে। তারা ৫ বছরে যে রেমিটেন্স এনেছিল আমরা ৩ বছরে এর তিনগুণ এনেছি। আমরা দেশকে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই বলেই উন্নয়ন বাজেট প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছি। আমরা গ্রামের সাধারণ মানুষের, নিম্নবিত্তের মানুষের উন্নয়ন চাই। নিম্নবিত্তের মানুষের আর্থিক সঙ্গতি এসেছে। প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষ মধ্যবিত্তের সারিতে যোগ হয়েছে। আমরা কৃষকের উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছি। কুইক রেন্টাল বিদ্যুতের সমালোচনার জবাবে তিনি বলেন, এ নিয়ে কয়েকদিন ধরেই সমালোচনার ঝড় বইছে। কুইক রেন্টার করে নাকি সর্বনাশ করেছি। কিন্তু সমালোচকদের জানানো উচিত, বিদ্যুৎ উপাদনের ফলেই কলকারখানায় উৎপাদন বেড়েছে। রপ্তানি বেড়েছে। মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে আমরা ১ কোটি ২২ লাখ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধা দিতে সক্ষম হয়েছি। আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বিতরণের জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ লাইনও নির্মাণ করেছি। ৫৩ শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে ২০০৮ সালে এটা ছিল ৪২ শতাংশ। তিনি দেশবাসীকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, যে খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় সে খরচে ব্যবহার করতে হবে। বিশ্বের যে কোন দেশের চেয়ে আমাদের দেশে বিদ্যুতের দাম কম। সাধারণ নিয়ম অনুসারে, আমরা যে খরচে বিদ্যুৎ উৎপাদন করবো মানুষকে সে দামেই কিনতে হবে। কিন্তু আমরা ভর্তুকি দিয়ে জনগণকে বিদ্যুৎ দিচ্ছি।
টিপাই নিয়ে যৌথ সমীক্ষার প্রক্রিয়া চলছে: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সমীক্ষা শুরু করার প্রক্রিয়া চলছে। গতকাল সংসদে লিখিত প্রশ্নোত্তরে তিনি এ কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, টিপাইমুখ প্রকল্পে ফলে বাংলাদেশে কি প্রভাব পড়বে সে বিষয়ে যৌথ সমীক্ষা পরিচালনার লক্ষ্যে দু’দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার প্রেক্ষিতে ভারত যৌথ সমীক্ষার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। এরইমধ্যে যৌথ সমীক্ষা দলের বাংলাদেশ পক্ষ গঠন করে ভারত সরকারকে জানিয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পানি আইন-২০১২ এর খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ খসড়া পানি আইনটি নীতিগতভাবে অনুমোদন দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজশাহী, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, ফরিদপুর ও বরিশাল অঞ্চলের সমন্বিত গঙ্গার পানি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণপূর্বক গঙ্গা ব্যারেজ প্রকল্পটি আশা করা যায় আগামী অর্থবছরে রাজবাড়ীর পাংশায় নির্মাণ কাজ শুরু হবে। তিস্তার পানি বণ্টন সম্পর্কে শেখ হাসিনা বলেন, ক্ষমতা গ্রহণের পর সরকার তিস্তার পানি বণ্টনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ নিয়ে চুক্তি করতে ভারতের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে। সংসদ নেতা বলেন, রাজউকের আওতাধীন ১৫২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকার জন্য ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-২০৩৫) প্রণয়নের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। নাজিম উদ্দিন আহমেদের প্রশ্নের জবাবে সংসদ নেতা বলেন, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডিসেম্বর ২০১১ পর্যন্ত মোট ২ লাখ ৩১ হাজার ১৫৭ জন লোক বিভিন্ন দপ্তরে নিয়োগ দিয়েছে। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৯১৭ জন এবং নারী ৭২ হাজার ২৪০ জন। চলতি অর্থবছরে কাবিখা ও টিআর কর্মসূচির মাধ্যমে আরও ৫৩ লাখ ৬৭ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।