ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ। গৌরবের ৯২ বছরে পা দিল প্রতিষ্ঠানটি। তৎকালীন পূর্ববাংলার পিছিয়ে পড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে উচ্চশিক্ষায় অগ্রসর করতে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষা ও গবেষণায় কলকাতা, মুম্বাই, করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। খ্যাতি লাভ করে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ যুগের অর্জিত সেই সুনামে ভাটা পড়ে স্বৈর শাসনামলে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে গত কয়েক বছরের জরিপে দেখা যায়, শীর্ষ দুই হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান। এশিয়ায়ও সেরাদের তালিকায় নেই এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে দেশের মধ্যে সেরা স্থান ধরে রেখেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৌরবোজ্জ্বল। যে কোনো সংকটপূর্ণ মুহূর্তে এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিয়েছেন জাতীয় সংকট উত্তরণে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসব ঐতিহ্যের নেই ধারাবাহিকতা। বর্তমানে নানা সমস্যায় জড়িত প্রতিষ্ঠানটি। শ্রেণীকক্ষের সংকট ও আবাসন সুবিধা অপ্রতুল। লাইব্রেরি সুবিধা বাড়ছে না। লেখাপড়ায় প্রযুক্তির ব্যবহার খুবই সীমিত। ‘গোলাপি’, ‘নীল’, ‘সাদা’ রঙে শিক্ষকদের দলাদলি বাড়ছেই। শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে। সংস্কৃতিচর্চার সুযোগ কমছে। দীর্ঘ দিন ধরে বন্ধ ছাত্র সংসদ নির্বাচন; অচল ডাকসু। এসব সংকট মোকাবেলায় এখন সোচ্চার হন না ছাত্রনেতারা। ছাত্র রাজনীতি লেজুড়বৃত্তির বৃত্তে বন্দি। সেরা শিক্ষার্থী হিসেবে ভর্তি হয়েও অনেকে লেখাপড়ায় অমনোযোগী। হ্যান্ডনোটের ফটোস্ট্যাট কপির কালচার এখন রমরমা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি রাশেদ খান মেনন বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান দিন দিন কমছে। এর কারণ শিক্ষকদের রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি, শিক্ষার্থীদের পাঠে অমনোযোগিতা, ডাকসু অচল করে রাখা ইত্যাদি। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ‘৭৩ অনুযায়ী যদি এটি পরিচালিত হতে পারে, তাতেই অনেক পরিবর্তন আসবে। ফিরে আসবে জ্ঞানচর্চার পরিবেশ।
এই বাস্তবতায়ই আজ পালিত হবে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘নারীর ক্ষমতায়নে উচ্চশিক্ষা’। বর্ণিল আয়োজনে উৎসবমুখর পরিবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের নবীন ও প্রবীণ সদস্যরা মিলিত হবেন প্রাণের বন্ধনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিল। সে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি বলেন, সীমিত সুযোগের কারণে জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত আন্তর্জাতিক মানের সুবিধা দেওয়া যাচ্ছে না।
র্যাংকিংয়ে শীর্ষ ২ হাজারের মধ্যে নেই :বিশ্বমানের দিক থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন অনেক পেছনে। আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়েবমেট্রিকসের সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ২৪৬৯ নম্বরে। এশিয়ার মধ্যে অবস্থান ৩৭।
বিদেশি শিক্ষার্থীশূন্য হচ্ছে :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্রমেই বিদেশি শিক্ষার্থীশূন্য হয়ে যাচ্ছে। ২০০০ সালেও বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২ শতাধিক। এখন এ সংখ্যা ১শ’র নিচে নেমে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার ভঙ্গুর পরিবেশই এ জন্য প্রধানত দায়ী বলে শিক্ষকরা মনে করছেন।
গবেষণা কেন্দ্র অনেক, গবেষণা কম :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৮টি গবেষণা কেন্দ্র থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটিতে গবেষণা হয়ে থাকে। এর মধ্যে কয়েকটি কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। কিছু গবেষণা কেন্দ্রের কাজ সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
দুর্নামের সূত্রপাত আশির দশকে :বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ-পরিস্থিতির আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে আশির দশক থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে শুরু হয় বন্দুকযুদ্ধ ও বোমাবাজির ঘটনা। বিস্তার ঘটে সশস্ত্র সন্ত্রাসের। ছাত্র সংসদ নির্বাচনে মেধা, ব্যক্তিত্ব, বাগ্মিতা, ব্যক্তিগত আচার-আচরণ ও চারিত্রিক মহিমার পরিবর্তে জায়গা করে নিতে থাকে পেশিশক্তি ও নোংরা ছাত্র রাজনীতি।
ডাকসু অচল ২২ বছর :২২ বছর ধরে অচল রয়েছে মিনি পার্লামেন্টখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)। স্বৈরাচারী সরকারের পতন-পরবর্তী ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারের আমলগুলোতেই বন্ধ হয়ে যায় ডাকসু নির্বাচন।
ছাত্র রাজনীতির হালচাল :ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যতটা দুর্নাম কুড়িয়েছে, তার অনেকটা দায় বর্তায় এই অপরাজনীতির ওপরই। গত ২০ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শতাধিক বার সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। প্রক্টর অফিস জানায়, গত ৫০ বছরে প্রায় ৭০ জন এ ক্যাম্পাসে নিহত হয়েছে। হল দখল-পাল্টা দখল আর টেন্ডারবাজিতে বোমা-আগ্নেয়াস্ত্রের ঝনঝনানির কারণে আতঙ্কের স্থলে পরিণত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বিগত কয়েক বছরে আগের অবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে ।
শিক্ষক রাজনীতি :’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখন-এখন’ নিবন্ধে সাবেক সচিব মাহবুবর রহমান ষাটের দশকের কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে পারস্পরিক দ্বেষ-বিদ্বেষ থাকলেও রাজনৈতিক বা অন্য কোনো রকম দলাদলি নজরে আসত না। এখন তো শিক্ষকদের অধিকাংশই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক এবং শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের সমর্থনসূচক লাল, নীল বা সাদা প্যানেলে ভোটাভুটি হয়।’ বিগত কয়েক বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া দেখলে বোঝা যায়, এখন শিক্ষক নিয়োগ হয় এ রাজনীতির ভিত্তিতেই।
কর্মসূচি :বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা করে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন শুরু করবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। রয়েছে কেক কাটা, স্মৃতিচারণ, বিতর্ক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। কেন্দ্রীয় শোভাযাত্রায় অংশ নিতে সকাল ৯টায় হল থেকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের র্যালি জড়ো হবে প্রশাসনিক ভবনের মল চত্বরে। সেখানে জাতীয় পতাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলোর পতাকা উত্তোলন করা হবে। সেখান থেকে টিএসসি পর্যন্ত হবে বর্ণিল শোভাযাত্রা। টিএসসি মিলনায়তনে আলোচনা ও স্মৃতিচারণমূলক অনুষ্ঠান হবে। ‘নারীর ক্ষমতায়নে উচ্চশিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। এ ছাড়া দুপুরে রয়েছে বায়োমেডিকেল ফিজিক্স অ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের উদ্যোগে গবেষণা ও আবিষ্কার বিষয়ক প্রদর্শনী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ ট্যুরিজম বিষয়ক কুইজ প্রতিযোগিতা, বিকেলে বিতর্ক অনুষ্ঠান, খেলার মাঠে প্রীতি ফুটবল এবং প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করবেন সঙ্গীত বিভাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রছাত্রীরা। রাতে নাট্যকলা বিভাগের উদ্যোগে নাটক পরিবেশিত হবে। চারুকলা অনুষদে শিশু চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা; মার্কেটিং বিভাগের উদ্যোগে সেমিনার, মেলা, রম্য বিতর্ক; মল চত্বরে আবৃত্তি, দেশাত্মবোধক গান, বাউল সঙ্গীত ও কাওয়ালি পরিবেশন করা হবে।