পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোন ধরনের দুর্নীতি হয়নি দাবি করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, যেখানে বিশ্বব্যাংক একটা পয়সাও ছাড় দেয়নি সেখানে কিভাবে দুর্নীতি হয়? তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে পরামর্শক
নিয়োগ দেয়া হয়। তারপরও তারা দুর্নীতির কথা নিয়ে এলো! এর পেছনে কে আছে তা খতিয়ে দেখা উচিত। একটি বিশেষ কোম্পানিকে নিয়োগ দেয়ার জন্য বিশ্বব্যাংক থেকে তিন তিনবার চিঠি দেয়া হয়। পরে দেখা গেল, সেই কোম্পানিটি ভুয়া। ওই কোম্পানির সঙ্গে বিদেশী মূল কোম্পানির কোন সম্পর্ক নেই। ফলে আমাদের বিশেষজ্ঞ কমিটি বিশ্বব্যাংকের ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। বিএনপি’র আমল থেকে আজ পর্যন্ত যোগাযোগ খাতে বিশ্বব্যাংক একটা পয়সাও দেয়নি। অথচ তারা আমাদেরকে দুর্নীতিবাজের অপবাদ দিলো। তারা কোথায় দুর্নীতি দেখেছে? বিশ্বব্যাংককে দুর্নীতিগ্রস্ত উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও ফোর্বস পত্রিকা পড়লেই দেশবাসী জানতে পারবেন দুর্নীতি কোথায় আছে। গতকাল জাতীয় সংসদে নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ফজলুল আজিমের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এটা তারা করতে পারে। অন্যরাও ইচ্ছা করলে অর্থায়ন বন্ধ করতে পারে। কিন্তু এই সেতু নির্মাণ বন্ধ করতে পারবে না। কারণ আমাদের ১৬ কোটি মানুষ আছে। পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করবোই। আমরা দরিদ্র হতে পারি। বিশ্বমন্দার মধ্যেও যদি আমরা আমাদের জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারি তাহলে পদ্মা সেতুও নির্মাণ করতে পারবো। মালয়েশিয়া প্রস্তাব দিয়েছে। আরও প্রস্তাব আসবে। বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোন প্রস্তাবে আমরা পদ্মা সেতু করবো না। পিপিপি’র মাধ্যমেও পদ্মা সেতু হতে পারে।
তিনি বলেন, আমরা সরকার গঠন করে দেখলাম বিএনপির আমলে দুর্নীতির কারণে বিশ্বব্যাংক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও যোগাযোগ খাতে সমস্ত অর্থায়ন বন্ধ রেখেছে। ফলে বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন কাজও হয়নি। এর মধ্যে ঢাকা ময়মনসিংহ সড়ক চার লেন করার কাজও বন্ধ রয়েছে। আমরা ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের অর্থায়নে ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন করার কাজ শুরু করেছি। পদ্মা সেতু নির্মাণের ইতিহাস তুলে ধরে তিনি বলেন, ’৯৬ সালে সরকারে এসে আমি জাপান সফরে গিয়ে পদ্মা ও রূপসা সেতু নির্মাণে সহযোগিতার আশ্বাস নিয়ে আসি। কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করে দেয়। তারা ৫ বছর ক্ষমতায় ছিল। তাদের দুর্নীতির কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা সম্ভব হলো না। এবার আমরা ক্ষমতায় এসে আবার পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নিলাম। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু অর্থায়ন করার সম্মতি দিলো। হঠাৎ করে বিশ্বব্যাংক বললো- পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হচ্ছে। যেখানে তারা একটি পাই (পয়সা)-ও ছাড় দেয় নাই। সেখানে দুর্নীতি কিভাবে হলো? আমরা দেড় হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভূমি অধিগ্রহণ করেছি। বিশ্বব্যাংক বারবার প্রতিনিধি পাঠিয়ে দেখেছে- সেখানে কোন দুর্নীতি হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির কথা বলার পর আমি তথ্য জানতে চাইলাম। উনি দু’টি চিঠি দিলেন। সেখানে বিএনপি’র আমলের যোগাযোগমন্ত্রীর নাম ছিল। আমাদের কোন মন্ত্রীর নাম নাই। তখন বিশ্বব্যাংক বললো- তাদের কাছে আরও তথ্য আছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন তথ্য দেননি তারা। শেখ হাসিনা বলেন, দুর্নীতি তদন্তের সুবিধার জন্য আমি যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী, সচিব এবং প্রকল্প পরিচালককে সরালাম। কিন্তু বিশ্বব্যাংক যখন দুর্নীতির দায়ে বিএনপি’র আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ বন্ধ করেছিল তখন বিএনপির যে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রী ছিল তাদেরকে সরানো হয়নি। যোগাযোগমন্ত্রীকেও সরায়নি। আমরা সরিয়েছি। কারণ আমরা সবসময় স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি। আমরা ক্ষমতায় বসে টাকা কামাতে আসিনি। জনগণের জন্য কাজ করতে এসেছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা এত খারাপ না যে, অন্যের সহযোগিতা না পেলে চলতে পারবো না। পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়ে আমাদের উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। গতকাল (মঙ্গলবার) গভর্নরসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করেছি। কিভাবে আমরা পদ্মা সেতু নির্মাণ করতে পারি সে কৌশল নিয়ে আলোচনা করেছি। দেশবাসীকে বলে রাখছি- পদ্মা সেতু আমরা নির্মাণ করবোই। সে সামর্থ্য আমাদের আছে।
প্রধানমন্ত্রীর পরিবারের নাম ভাঙিয়ে কেউ যাতে সুবিধা না নিতে পারে সেজন্য নিজের মোবাইল ফোন নম্বর (০১৭১১৫২০০০০ ও ০১৮১৯২৬০৩৭১) এবং ই-মেইল ঠিকানা ংযবরশযযধংরহধ@যড়ঃসধরষ.পড়স জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের পরিবারের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি কিছু করতে চায় তাহলে আমাকে জানান। আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবো। আমার পরিবার বলতে আমি, আমার ছোট বোন এবং ৫ ছেলেমেয়ে। এর বাইরে আমাদের কোন পরিবার নেই। আমাদের পরিবার কোন ধরনের দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।
মন্ত্রীদের দুর্নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে মুহূর্তে কোন মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণ হবে সেই মুহূর্তেই তার মন্ত্রিত্ব চলে যাবে। কারণ, আমাদের মন্ত্রী হওয়ার মতো যোগ্য এমপি’র অভাব নেই। আওয়ামী লীগের ২৩০ জন এমপি রয়েছেন। এদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র মন্ত্রী। অন্য এমপিদের অনেকেই মন্ত্রী হতে চান। তাদের যোগ্যতারও অভাব নেই। সুতরাং দুর্নীতিবাজ কাউকে মন্ত্রী হিসেবে রাখার প্রয়োজনও নেই।
নাছিমুল আলম চৌধুরীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিশ্বের দ্রুত বেড়ে ওঠা মেগাসিটিগুলোর অন্যতম রাজধানী ঢাকার লোকসংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি- যা দেশের মোট জনসংখ্যার ১০% এর বেশি। আর দ্রুত নগরায়নের ফলে গত কয়েক দশকে যানবাহনের চাহিদাও কয়েক গুণ বেড়েছে। কিন্তু বিগত সরকারগুলোর আমলে রাস্তাঘাটের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়নি। এছাড়া আর্থিক সচ্ছলতা বৃদ্ধির ফলে পরিবার পিছু গাড়ি ব্যবহারের সংখ্যা বেড়েছে।
তিনি বলেন, ঢাকামুখী জনস্রোত রোধ করার জন্য পৃথক কোন পরিকল্পনা কমিশন গ্রহণ না করলেও সরকারের গৃহীত ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১১-১৫) নগরায়ন সমস্যাকে প্রাধান্য দিয়ে ১০টি খাতের মধ্যে একটি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে এবং দলিলটিতে নগরায়নকে বাস্তবমুখী ও নাগরিক সুবিধা সংবলিত করার জন্য প্রয়োজনীয় লক্ষ্য নির্ধারণ ও দিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
কেএম খালিদের এক সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ’৬১ সালে ধানমন্ডির মানুষ বলতো ঢাকায় যাচ্ছি। তখন ধানমন্ডি ঢাকার অংশ ছিল না। বর্তমানে নতুন ঢাকা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে ঢাকার চারদিকে চারটি স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এছাড়া মানুষ যাতে ঢাকামুখী না হয় সেজন্য সরকারকে বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হচ্ছে।
মো. শফিকুল ইসলামের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলের অন্যতম মৎস্য ভাণ্ডার চলনবিল রাজশাহী বিভাগের ৬টি জেলায় বিস্তৃত। ওই জলাভূমি এলাকা দেশীয় নানা প্রজাতির মাছের প্রজনন ও বংশবিস্তারের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এক সময় পরিচিত ছিল। ক্রমশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় এ বিল থেকে মৎস্য উৎপাদন ও আশপাশের জলাশয়গুলোর জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল এবং এ বিলের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক অবনতি ঘটেছিল। চলনবিলকে তার আগের অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় শুধুমাত্র এ বিলের মৎস্য সম্পদ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে।