জার্মানিতে পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ ইন্টারনেটে আসক্ত। তাদের মধ্যে দেখা যায় অ্যালকোহল ও মাদকাসক্তির মতো লক্ষণ। পেশাগত ও সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তারা। দেখা দেয় শারীরিক ও মানসিক সমস্যা।
ক্লাউস ইন্টারনেটে দারুণ আসক্ত এক ব্যক্তি। এই আসক্তি বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে ওঠে যে, এক সময় তার যেন নিজস্ব অস্তিত্ব হারিয়ে যায়, একাকার হয়ে যায় ইন্টারনেটের সঙ্গে। ৯০-এর দশকের শেষ দিকে প্রথম ইন্টারনেটের সংস্পর্শে আসেন ক্লাউস। ই-মেইল ঠিকানা খোলেন, চ্যাট ও সার্ফিংয়ের সঙ্গে হয় হাতেখড়ি। সে সময় অবশ্য ব্যাপারটা সহনীয় পর্যায়ে ছিল। প্রতিদিনের কোনো বিষয় ছিল না। ক্লাউস জানান, ইন্টারনেটের ফাইনাল ফ্যান্টাসির মতো ভার্চুয়াল গেমগুলো আমাকে নেশার জগতে নিয়ে আসে। এসব খেলায় একবার ডুবে গেলে আমি সময় ও জগত্সংসার একেবারে ভুলে যেতাম।
ক্লাউস বন্ধু-বান্ধব ও পরিচিতদের অবহেলা করা শুরু করলেন। এমনকি ঘুম ও নাওয়া-খাওয়ার কথাও মনে থাকত না তার। রাতগুলো কেটে যেত ইন্টারনেটের জগতে। ঘুম থেকে উঠলেই চুম্বকের মতো টানত তাকে ইন্টারনেট।
জার্মান সরকারের নেশাসম্পর্কিত সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানা গেছে, ইন্টারনেটের নেশা ক্লাউসের একার সমস্যা নয়। এই নেশা এক সামাজিক সমস্যা। জার্মানির ১৪ থেকে ৬৪ বছর বয়স্কদের মধ্যে ৫ লাখ ৬০ হাজার ইন্টারনেটে আসক্ত। এছাড়া ২৫ লাখ জনের মধ্যে ইন্টারনেটের কারণে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
মানসিক রোগের চিকিত্সা ও থেরাপি কেন্দ্র, রাইন ইউরা ক্লিনিকের প্রধান চিকিত্সক ডা. মিখাইল বেন্ডার বলেন, মদ ও হেরোইন আসক্তদের মতো লক্ষণ দেখা দেয় ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলদের। ইন্টারনেটের নেশা থেকে মুক্ত করতে চাইলে তারা মাদকাসক্তদের মতোই যন্ত্রণা অনুভব করেন। ডা. বেন্ডার জানান, অনেকেই লক্ষ্য করেন, তারা সামাজিক কাজকর্ম ও অবসর সময়ে অন্য কিছু করা থেকে বিরত থাকছেন। কিন্তু এসব বুঝেও ইন্টারনেটের নেশা থেকে বের হতে পারেন না তারা। হারিয়ে ফেলেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ।
হানোফার শহরের শিশু হাসপাতালের মানসিক বিভাগের চিকিত্সক ক্রিশটাফ মোলার বলেন, অতিরিক্ত মাত্রায় ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই যে কেউ তাতে আসক্ত—একথা বলা যায় না। সমস্যাটা হয় তখনই, যখন কারও ক্ষতি হয়, যেমন স্কুলে যাওয়া বা সামাজিক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া। ডিপ্রেশন, ভীতি ইত্যাদি মানসিক সমস্যা থেকেও অনেকে ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বাস্তব জীবনে সমস্যা হলে কল্পলোকে সান্ত্বনা খোঁজেন তারা। মন-মেজাজ ভালো না থাকলেও ইন্টারনেট দিয়ে তা পুষিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়।
অল্পবয়সী অর্থাত্ ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যেই ইন্টারনেটে ডুবে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আনুমানিক আড়াই লাখ তরুণ-তরুণী ইন্টারনেটে আসক্ত। বিশেষ করে অনলাইন গেম নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তারা। অল্প বয়সীদের মধ্যে আবার ছেলেরাই ইন্টারনেটের আবর্তে পড়েন বেশি। তবে ফেসবুক, চ্যাটিং ইত্যাদির মতো সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেয়েরা এগিয়ে আছে।
ক্রিশটাফ মোলার জানান, এ ক্ষেত্রে উদ্বেগ জাগানোর মতো ঘটনাও ঘটে। ইন্টারনেটের ঘেরাটোপে পড়ে অনেক মা এমনকি নিজের সন্তানদেরও অবহেলা করতে থাকেন। তাই বলা যায় প্রযুক্তির এই মাধ্যমটি শুধু পুরুষদেরই সমস্যা নয়। চিকিত্সা জগতে ইন্টারনেটের নেশাকে এখন পর্যন্ত আলাদা রোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আমরা এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছি। ২০০৮ সালে মাইন্স ইউনিভার্সিটির মানসিক ক্লিনিকে ইন্টারনেট আসক্তদের জন্য জার্মানির প্রথম বহির্বিভাগীয় চিকিত্সা কেন্দ্র খোলা হয়। এর মধ্যে অন্য শহরেও এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। থেরাপিতে ইন্টারনেটের সঙ্গে একটা সুস্থ সম্পর্ক গড়ে তুলতে শেখানো হয় রোগীদের। এছাড়া নিজের শরীর সম্পর্কেও সচেতন করে তোলা হয়। প্রণোদিত করা হয় অন্য কোনো শখের বিষয় খুঁজে নিতে। থেরাপির মাধ্যমে ধীরে ধীরে কর্মজীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় আসক্তদের।
মিশাইল বেন্ডারের মতে, ভুক্তভোগীদের অবস্থা অবশ্য সরু সুতায় ঝোলার মতো। অর্থাত্ সুস্থ হলেও একটুতেই কাত হয়ে পড়তে পারেন তারা। কেননা একবিংশ শতাব্দীতে এসে কেউ পেশাগত বা ব্যক্তিগত কোনো দিক দিয়েই ইন্টারনেটকে এড়িয়ে চলতে পারে না।
ক্রিশটাফ মোলার জোর দিয়ে বলেন, মা-বাবার উচিত, বাচ্চাদের ঘর টিভি বা কম্পিউটারের স্ক্রিনমুক্ত রাখা। কেননা ছোটদের শারীরিক ও মানসিক বর্ধনের জন্য প্রয়োজন আবেগ-অনুভূতির জাগরণ, মানুষের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ। তার ভাষায়, তবে অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও সব সময় ইতিবাচক আদর্শ স্থাপন করতে পারেন না। আজ অপেরা বা এমন কোনো অনুষ্ঠান নেই, যেখানে অনুষ্ঠান চলাকালে মোবাইল ফোন বেজে না ওঠে। সূত্র : ডিডব্লিউ