শিক্ষাঙ্গনে যৌন নিপীড়নের ঘটনা তদন্তে ২০০৯ সালে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে-উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়নবিরোধী তদন্ত কমিটি গঠন করার নির্দেশনা দেন হাইকোর্ট। কিন্তু ওই নির্দেশনা মানছে না অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অন্যতম। এখানে যৌন নিপীড়ক ১৫ শিক্ষক। তারপরও তারা বহাল তবিয়তে।
জানা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ সদস্যের একটি উচ্চপর্যায়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কমিটির আহ্বায়ক করা হয় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেনÑ সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এ এফ এম মেজবাহউদ্দীন, সৈয়দ রেজাউর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার সৈয়দ রেজাউর রহমান (সদস্য সচিব)।
কিন্তু কমিটির নারী সদস্য অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম জানান, এ কমিটি গঠনের পর কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বলা যায়, নামকাওয়াস্তে কমিটি। তিনি বলেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রীরা নিরাপদ নন। তারা শিক্ষকদের দ্বারাও নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। অভিযোগও হচ্ছে। কিন্তু তারা বিচার পাচ্ছেন না।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রীরা নিরাপদ নন। শিক্ষক কর্তৃক নানাভাবে হয়রানির শিকার হন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন হয়।
অভিযোগও পড়ে; কিন্তু কোনো বিচার হয় না। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ১০ বছরে কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ব্যবস্থা না নেয়ায় কয়েকজন ছাত্রী অভিমানে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমপক্ষে ১৫ শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে, যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী বিভাগেরই এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে ভিসির কাছে যে অভিযোগ করেছেন তার একপর্যায়ে লেখা আছে ‘তিনি বইটি নিয়ে টেবিল ঘুরে এসে আমার হাতে দিলেন। আমি বইটি হাতে নেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার চেষ্টা করেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে একটি কমিটি আছে। এ কমিটির কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন কমিটিরই একজন সদস্য অধ্যাপক তাজমেরী এস এ ইসলাম। কমিটি গঠনের পর প্রায় দুবছর হলেও আজ পর্যন্ত কোনো বৈঠক হয়নি।
অথচ কমপক্ষে ১৫ জন শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ছাত্রীরা। সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকার পরও অব্যাহতি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে তাদের স্ত্রী-সন্তান সবই আছে।
শিক্ষকরা ছাত্রীদের সঙ্গে নানা কৌশলে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে টিউটোরিয়াল, ইনকোর্স ও অ্যাসাইনমেন্টের নম্বরকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। প্রথমে প্রেম। এরপর বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কও স্থাপন করেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ের নামে নানাভাবে কালক্ষেপণ করেন। উপায়ন্তর না দেখে অসহায় ছাত্রীরা কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। কেউ কেউ আত্মহত্যা পর্যন্ত করেন। শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে বিয়ে না করায় সম্প্রতি কুয়েত মৈত্রী হলের এক ছাত্রী আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। শিক্ষকদের কুপ্রস্তাবে রাজি না হলে ২০ নম্বরের মধ্যে শূন্য নম্বর দেয়ারও হুমকি এমনকি ফাইনাল পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেয়ারও হুমকি দেন। এভাবেই ছাত্রীদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন।
কখনো বই দিয়ে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি, নোট করে দেয়ার কথা বলেও হয় যৌন নিপীড়ন। অনেক সময় স্ত্রীকে বাসার বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ছাত্রীদের মাসের পর মাস বাসায় রাখার ঘটনাও ঘটেছে। পরিসংখ্যান, প্রাণ পরিসংখ্যান ও তথ্য পরিসংখ্যান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. জাফর আহমেদ খানের বিরুদ্ধে পরকীয়া, নিপীড়ন ও যৌতুকের অভিযোগ আনেন তারই স্ত্রী রেবেকা পারভীন ।
তিনি জাফরের বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযোগ করেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে। জুনে তার বিরুদ্ধে স্ত্রী এ অভিযোগ করেন। স্ত্রী রেবেকা পারভীন বলেন, প্রথমদিকে বিষয়টি আমি পারিবারিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে পরনারীতে আসক্তের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। বাসায় ছাত্রীদের নিয়ে রাখতেন বলেও জানান তিনি।
প্রতিবাদ করলে তার ওপর নেমে আসত নির্যাতনের খড়গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ দুঃখজনক এবং হতাশাজনক।