ঢাকা, ১৭ জুলাই: পদ্মা সেতু প্রকল্পে নিজেদের অর্থায়ন বাতিল বিষয়ে অবশেষে বিস্তারিতভাবে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মঙ্গলবার সংস্থাটির ওয়াশিংটনস্থ অফিস থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি হিসেবে দেয়া এই বিবৃতিতে ১২টি বিষয়ে প্রশ্নোত্তর আকারে ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
১. বিশ্বব্যাংক কি তদন্তের ফলাফল সরকারকে জানিয়েছে?
নিজস্ব নীতির অনুসারে বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং এ বছর এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে দুটি দলিল দিয়েছে। বিষয়টির পূর্ণ তদ্ন্ত করে যথাযথ বিবেচিত হলে দুর্নীতির জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়ার জন্য আমরা কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানিয়েছিলাম।
২.সরকারকে দেয়া বিশ্বব্যাংকের সুপারিশমূলক প্রতিবেদনে কি কি ছিল?
সরকারের কাছে সুপারিশমূলক প্রতিবেদন দেয়ার লক্ষ্য ছিল দুর্নীতির নির্ভরযোগ্য প্রমাণ সম্পর্কে একটি যথাযথ জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে জোরদার তদন্ত করা। বিশ্বব্যাংকের স্বাধীন ইন্টেগ্রিটি ভাইস প্রেসিডেন্সি দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান করে দেখে যে ব্যাংকের দুর্নীতি বিরোধী দিক নির্দেশনা লঙ্গিত হয়েছে কি না এবং জাতীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদন্ত করার জন্য যথেষ্ঠ নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে কি না। বিশ্বব্যাংক নিজে কোনো অপরাধেল তদন্ত করে না কিংবা পরবর্তী করণীয় করে না। এটা পুরোপুরি বাংলাদেশি আইনের অনুসারে বাংলাদেশ সরকারের বিবেচ্য।
৩.বিশ্বব্যাংকের দেয়া এই প্রতিবেদনগুলো সরকার কেন প্রকাশ করছে না?
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণগুলো বিশ্বব্যাংক ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ও ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করেছে। এসব সুপারিশমূলক প্রতিবেদনের গোপনীয়তা বজায় রাখতে বাংলাদেশসহ সব দেশের সরকারের কাছে বিশ্বব্যাংকের দায়বদ্ধতা রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার চাইলে এই সব প্রতিবেদন ও চিঠিগুলো প্রকাশ করতে পারে। স্বচ্ছতা রক্ষার স্বার্থে এসব প্রকাশের জন্য আপনারা সরকারকে অনুরোধ করতে পারেন।
৪. বিশ্বব্যাংক কি কি প্রস্তাব দিয়েছিল? এর কোনটি সরকার গ্রহণ করেছিল?
বিশ্বব্যাংক পরামর্শ দিয়েছিল যে সরকার চারটি পদক্ষেপ নিতে পারে। কিন্তু এই চারটির মধ্যে সরকার দুটি গ্রহণ করতে পারেনি। প্রথমত, দুর্নীতি দমন কমিশনকে একটি বিশেষ যৌথ তদন্ত ও বিচারিক দল গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল-যাতে দুদক সম্মতি দিয়েছিল।
দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সরকার একটি বিকল্প ব্যবস্থায় সম্মত হয়েছিল- যাতে সহযোগী অর্থায়নকারীদের জন্য ক্রয় প্রক্রিয়ায় অধিকতর তদারকির সুযোগ ছিল।
তৃতীয়ত, বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে একটি স্বতন্ত্র পর্ষদের কাছে তথ্য দেয়ার এবং তদন্ত প্রক্রিয়ার পর্যাপ্ততা মূল্যায়নে এই পর্ষদকে সুযোগ দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো- কিন্তু দুদক শেষ পর্যন্ত এমন স্বতন্ত্র পর্ষদের সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রাখতে সম্মতি দেয়নি।
চতুর্থত, বাংলাদেশি আইনে বিধান থাকা সত্ত্বেও তদন্ত চলাকালে সরকারি দায়িত্ব পালন থেকে আমলা ও রাজনৈতিকভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত সরকারি ব্যক্তিবর্গকে ছুটি দিতে সরকার রাজি হয়নি।
চারটি ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শের মধ্যে দুটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছতে ব্যর্থ হবার কারণে সেতুর জন্য সহায়তা বাতিল করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প বিশ্বব্যাংকের ছিল না।
৫. বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাবগুলো বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ?
দুর্নীতির সব অভিযোগ এবং বিশ্বব্যাংকের অনুরোধকৃত সব পদক্ষেপ পুরোপুরিভাবে বাংলাদেশের আইন, রীতি-নীতি ও বিধি –বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রেখেই করা হয়েছে।
৬. একটি চীনা প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বব্যাংক পক্ষপাত করেছে কি?
এটা একেবারেই সত্য নয়। কোনো প্রতিষ্ঠানকেই বিশেষ আনুকূল্য দেখায় না বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চলা কোনো ক্রয় প্রক্রিয়া আমরা যখন পর্যবেক্ষণ করি, তখন এটি সরকারের দায়িত্ব থাকে যে প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের সময় কোনটি প্রতিষ্ঠানটি সক্ষম আর কোনটি সক্ষম না তা মূল্যায়নের ন্যায্যতা দেয়া। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর মতো বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন ছাড়িয়ে যাওয়া প্রকল্পের ক্ষেত্রে; কেন প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেবার জন্য যোগ্য অথবা তাদের যোগ্যতার অভাব রয়েছে কি না- সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ও সুদৃঢ় ব্যাখ্যা দেয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সেতু বিভাগ যথেষ্ঠ তথ্যাদি ছাড়াই চায়না রেলওয়ে কনস্ট্রাকশন করপোরেশনকে প্রাকযোগ্যতা থেকে বাদ দিয়েছিল। বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে সেতু কর্তৃপক্ষকে আরো তথ্য চাইতে ও প্রয়োজনীয় যথার্থতা দেখাতে অনুরোধ করা হয়েছে। যখন এই তথ্য দেয়া হয়, তখন এই প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিতে সরকারের সিদ্ধান্তের সঙ্গে সম্মত হয় বিশ্বব্যাংক। এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ও সরকারের কোনো দ্বিমত নেই এবং বিশ্বব্যাংক বরাবরই নিরপেক্ষ থেকেছে।
৭. চুক্তি কার্যকর হবার একমাস আগেই বিশ্বব্যাংক প্রকল্প বাতিল করলো কেন?
প্রায় একবছর ধরে সরকারের সঙ্গে আলোচনা ও দুর্নীতির প্রমাণ সম্পর্কে যথার্থ ব্যবস্থা নেয়ার প্রসঙ্গে সরকারের ইতিবাচক সাড়ার জন্য অপেক্ষা করেছে বিশ্বব্যাংক। দুঃখজনক যে প্রায় নয় মাসেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি সরকার। সেতুর সম্ভাবনা এবং এর জনগুরুত্বের কথা বিবেচনা করে প্রকল্পটি বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে গেছে বিশ্বব্যাংক। জরুরি ভিত্তিতে এ ব্যাপারে একটি উপায় বের করার জন্য ঢাকায় একটি উচ্চ পর্যায়ের দল পাঠিয়েছিলো বিশ্বব্যাংক। কয়েকদিনের আলোচনার পর, চারটি প্রস্তাবের দু’টি সরকারের দিক থেকে গ্রহণ করা অসম্ভব বলে জানানোর পর বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিলের কঠিন সিদ্ধান্তটি নিতে বাধ্য হয়।
৮. বিশ্বব্যাংকের দেয়া বিবৃতিটি বিদায়ী প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত মতামতের প্রতিফলন?
বিশ্বব্যাংকের সব সিদ্ধান্তই প্রাতিষ্ঠানিক, কোনোটিই ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। এটি বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপনার সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত ছিল, কারো একক সিদ্ধান্ত নয়। দুর্নীতি মোকাবিলায় সরকারের সদিচ্ছার অভাবের প্রভাবেই এই সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণের জন্য যেমন দুঃখজনক তেমনি দুঃখজনক বিশ্বব্যাংকের জন্যও, বিশেষ করে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের দীর্ঘ সম্পর্কের আঙ্গিকে, যেই অংশীদারিত্বের সম্পর্ক বাংলাদেশের প্রায় জন্মের পর হতেই চলমান। পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে সম্পৃক্ত না থাকা বিশ্বব্যাংকের জন্যও সমান দুঃখজনক।
৯. বাংলাদেশকে দেয়া বিশ্বব্যাংকের ঋণের সুদ কত?
বিশ্বব্যাংকের অঙ্গসংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সি-আইডিএ থেকে বাংলাদেশ সুদ মুক্ত ঋণ নেয়। প্রাপ্ত সুদ মুক্ত ঋণের মেয়াদ ৪০ বছর (১০ বছর রেয়াত সহ) এবং সার্ভিস চার্জ প্রযোজ্য। এগার থেকে কুড়িতম বছরের মধ্যে প্রতিবছর ঋণের শতকরা দুই ভাগ শোধ করতে হয়। বাকি কুড়ি বছরে প্রতি বছর আসলের শতকরা চার ভাগ শোধ করতে হয়।
১০. অন্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশকে ভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে?
না। এই ধরণের ঘটনায় যে কোনো দেশে হলেই একই ধরণের পরিণাম হতো।
১১. প্রকল্প বাতিল কি বিশ্বব্যাংকের অন্যান্য চলমান কার্যক্রমকে ব্যহত করবে?
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ঋণ বিষয়ে এ সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের ব্যাপক কর্মসূচির ওপর কোনো সরাসরি প্রভাব রাখবে না।
১২. ঋণ বাতিলের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার কোনো অবকাশ আছে?
অন্য অন্য দেশে এমন বাতিলকৃত ঋণ পুনরায় চালু করার ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের মাত্র কয়েকটি নজির আছে, ফলে পদ্ধতিগত দিক থেকে এটা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান পারিপার্শ্বিক অবস্থায় এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার খুবই সামান্য সুযোগ আছে। কারণ পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির প্রমাণের ব্যাপারে একটি পূর্ণ ও সুষ্ঠু তদন্তের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত দুটি পদক্ষেপ নিতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।