নুহাশপল্লী’ নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হুমায়ূন আহমেদ, প্রায় ৪০ বিঘার ওপর নির্মিত এই নন্দনকাননকে হুমায়ূন আহমেদ ট্রাস্ট করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন বলে দাফন শেষে জানান শাওন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনের আদলে গড়ে তুলব নুহাশপল্লী এমন কথাও তিনি বলেছিলেন। আইনানুযায়ী, নুহাশপল্লী ট্রাস্ট হলে এ সম্পত্তি বণ্টন করা যাবে না।
একই সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বর্তমান স্ত্রী হওয়ার কারণে এ ট্রাস্টের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন শাওন। অর্থাৎ এতে নুহাশপল্লী একপ্রকার শাওনের কাছেই থেকে যাবে। শাওনের এই কূটচালে আগুনে ঘি ঢেলে দেয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে ওই পরিবারে।
জানা গেছে, হুমায়ূন আহমেদের স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রয়েছে সেন্টমার্টিনে ‘সমুদ্রবিলাস’, ধানম-ির ৩/এ নম্বর সড়কে ‘দখিন হাওয়া’ একটি ফ্ল্যাট, উত্তরায় রাজউকের ৫ কাঠার একটি প্লট, তেঁতুলিয়ায় ৫ কাঠা জমি ও মোহাম্মদপুরের বছিলায় ৫ কাঠা জমি। একই সঙ্গে ধানম-ির ১০/এ সড়কে হুমায়ূন আহমেদের একটি পাঁচতলা বাড়ি আছে।
জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই ভক্ত ও দেশবাসীর। মৃত্যুর পর তার মরদেহ নিয়ে টানাটানি দেখে তার সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়েও গ-গোলের আশঙ্কা করছেন অনেকে। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় হুমায়ূন আহমেদের নিজের নামে ও তার দুই পরিবারের সদস্যদের নামে অনেক সম্পত্তি আছে। এখন এ সম্পত্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সূত্র জানায়, গাজীপুরের হোতাপাড়ার পিরুজালী গ্রামের মাঝখানে অবস্থিত ‘নুহাশপল্লী’। যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি।
প্রায় ৪০ বিঘার ওপর নির্মিত এই নন্দনকাননকে ট্রাস্ট করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। এমনটাই মঙ্গলবার দাফন শেষে জানান শাওন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনের আদলে গড়ে তুলব নুহাশপল্লীÑ এমন কথাও তিনি বলেছিলেন।
এ ছাড়াও হুমায়ূন আহমেদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় ৩৩ কাঠার ওপর নির্মিত ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ নামে বাংলাদেশের সবচেয়ে আধুনিক একটি বিদ্যালয় রয়েছে। এর পাশাপাশি নেত্রকোনাতেও তার বেশ কিছু স্থাবর সম্পত্তি আছে। তবে তার নগদ অর্থের পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।
স্থাবর সম্পত্তির পাশাপাশি তিনি আরো রেখে গেছেন অমূল্য সম্পদ, তার বই। হুমায়ূন আহমেদ প্রায় তিনশ বই লিখেছেন। যার মধ্যে দেড়শতাধিক বইয়ের কপিরাইট প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন খানের নামে। এরপরের প্রায় একশ বই ও অর্ধশতাধিক সংকলনের কপিরাইট দ্বিতীয় স্ত্রী শাওনের নামে। উল্লিখিত বই থেকে বিক্রিলব্ধ যে অর্থ পাওয়া যাবে, তা এখন তারা পাবেন।
এ ছাড়া নুহাশ চলচ্চিত্র ও লীলাবতি কথাচিত্র নামে দুটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থাও রয়েছে হুমায়ূন আহমেদের। এগুলোর বিষয়েও এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
পারিবারিক সূত্র জানায়, নিউইয়র্কে বসে হুমায়ূন আহমেদ তার সম্পত্তি বণ্টন করেননি। তবে সেন্টমার্টিনের ‘সমুদ্রবিলাস’ শাওনের নামে তিনি লিখে দিয়েছেন বলে সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, যেসব সম্পত্তি কারো নামে লিখে দেয়া হয়নি, সেগুলো মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী বণ্টন হবে। আইন অনুযায়ী, হুমায়ূন আহমেদের পুরো সম্পত্তির ৬ ভাগের ১ ভাগ পাবেন তার মা আয়েশা ফয়েজ। বাকি সম্পত্তির ৮ ভাগের ১ ভাগ পাবেন শাওন।
এরপরের অবশিষ্ট সম্পত্তি ৯ ভাগে বিভক্ত হবে। এই ৯ ভাগের মধ্যে ১ ভাগ করে পাবেন হুমায়ূন আহমেদের প্রথমপক্ষের তিন মেয়ে নোভা, শীলা ও বিপাশা আহমেদ।
বাকি ছয় ভাগ সমান দুই ভাগ করে পাবেন হুমায়ূন আহমেদের প্রথমপক্ষের ছেলে নুহাশ হুমায়ূন এবং দ্বিতীয়পক্ষের দুই সন্তান নিষাদ ও নিনিত হুমায়ূন। তবে যেহেতু নিষাদ ও নিনিত এখনো নাবালক, সেহেতু তাদের সম্পত্তির দেখভাল করবেন তাদের মা শাওন।
হুমায়ূন আহমেদের ছোটভাই কার্টুনিস্ট আহসান হাবীব বলেন, আমরা এসব বিষয়ে এখনো কিছু চিন্তা করছি না। আমরা শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। আর বড় ভাইয়ের সম্পত্তি কী আছে বা না আছে তা আমরা পুরোপুরি জানিও না, যা আছে আইনসঙ্গতভাবে তা বণ্টন হবে বলে আশা করি। নুহাশপল্লীকে ট্রাস্ট করার বিষয়ে তিনি বলেন, যার যা ইচ্ছা তা বলছে, করছে। এসব বিষয়ে আসলে বলার কিছুই নেই। দেখা যাক কী হয়।
ট্রাস্ট গঠন বিষয়ে প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, হুমায়ূন আহমেদের সম্পত্তির যারা ওয়ারিশ, তারা চাইলে ট্রাস্ট হতে পারে। তবে সবাই না চাইলে এটা হবে না। সে ক্ষেত্রে একজনও যদি ট্রাস্ট করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়, তাহলে সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করে নিতে হবে।
ব্যারিস্টার রফিকের মতে, মেহের আফরোজ শাওনের একার সিদ্ধান্তে ট্রাস্ট গঠন সম্ভব না। তবে শাওন যদি তার ভাগে পাওয়া সম্পত্তি নিয়ে ট্রাস্ট করেন, তবে তা হবে। তিনি জানান, হুমায়ূনের অপরপক্ষের (গুলতেকিনের) চার ছেলেমেয়ে তার উত্তরাধিকারী হবেন।
বিচ্ছেদ হওয়ায় গুলতেকিন কোনো অংশ পাবেন না।এ ছাড়া শাওন ও তার দুই ছোট ছেলেও সম্পত্তির ওয়ারিশ। বোর্ড অব ট্রাস্টি গঠন বিষয়ে জানতে চাইলে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম বলেন, মৃত্যুর আগে হুমায়ূন আহমেদ ট্রাস্ট গঠন না করে গেলে, তার সব সম্পত্তি ওয়ারিশদের মধ্যে ভাগ করে দিতে হবে।
তিনি বলেন, লেখক যদি কারো নামে সম্পত্তি গিফট করে যান, সেই সম্পত্তির নামে ট্রাস্ট হতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা যতদূর জানি, হুমায়ূন আহমেদ কাউকে কোনো সম্পত্তি গিফট করে যাননি। সে কারণে মেহের আফরোজ শাওন তার একার সিদ্ধান্তে ট্রাস্ট গঠন করলে তা আইনসিদ্ধ হবে না। বিষয়টিতে কথা বলতে মেহের আফরোজ শাওনকে ফোন করা হলে শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি কথা বলতে রাজি হননি।
তবে তার সঙ্গে থাকা ঘনিষ্ঠ একজনের মাধ্যমে শাওন এই প্রতিবেদককে বলেন, হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্ন পূরণের অংশ হিসেবে ট্রাস্ট গঠন করা হবে।
হুমায়ূনের স্বপ্ন পূরণ করতে যা কিছু করা দরকার তা তিনি করবেন। শাওনের মা তহুরা আলী এমপি বলেন, এ মুহূর্তে বিষয়টি নিয়ে কথা বলা অত্যন্ত কষ্টকর। তবু শাওন সংবাদমাধ্যমের কাছে অনেক কথাই বলেছে। সেটা আপনারাও শুনেছেন। তবে হুমায়ূনের চিন্তা ছিল ট্রাস্ট গঠন করার ব্যাপারে।