ঢাকা, ৩১ জুলাই: তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকা আর্থিক প্রতারণা ও অবৈধভাবে অর্থ স্থানান্তরের অভিযোগে ডেসটিনি গ্রুপের সভাপতি লে. জেনারেল অব. হারুন অর রশিদ ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আমীনসহ প্রতিষ্ঠানটির ২২ শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পৃথক দুটি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। উল্লেখ্য, জনাব হারুন সাবেক সেনাপ্রধান।
মঙ্গলবার দুপুরে দুদক’র পক্ষে সহকারী পরিচালক তৌহিদুল ইসলাম এবং উপ-ব্যবস্থাপক মোজাহার আলী সরদার কলাবাগান থানায় এই মামলা দুটি করেন। মামলা নং ৩২ ও ৩৩।
বিকেলে দুদকের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
মামলার অভিযোগে দেখা যায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশন ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে প্রায় চার হাজার কোটি সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্তমানে তাদের পৃথক দুটি অ্যাকাউন্টে ৫৬ লাখ ও চার কোটি ৮৭ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। বাকি টাকা তারা অবৈধভাবে স্থানান্তরের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে। দুদক জানায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করে কমিশন হিসেবে তা থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা কর্মকর্তা ও এজেন্টদের কাছ থেকে আত্মসাৎ করে।
সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন ও ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীন ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির যেসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা হলেন— ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের পরিচালক মোহাম্মাদ হোসেন, পরিচালক সাঈদ-উর-রহমান, গোফরানুল হক, মেজবাহ উদ্দিন স্বপন, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, ইরফান আহমেদ সানি, মিসেস ফারাহ দীবা, জমসেদ আরা চৌধুরী, শেখ তৈয়বুর রহমান, নেপাল চন্দ বিশ্বাস, ইঞ্জিনিয়ার শেখ তৈয়বুর রহমান, জাকির হোসেন, আজাদ রহমান, আকরাম হোসেন সুমন, মিসেস শিরিন আক্তার, মো. রফিকুল ইসলাম সরকার, মো. মজিবুর রহমান, মো. সুমন আলী খান, মো. সাইদুল ইসলাম খান (রুবেল), মো. আবুল কালাম আজাদ ও লে. কর্নেল দিদারুল আলম।
অভিযোগে বলা হয়, এ দুই প্রকল্প থেকে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা প্রথমে বিভিন্ন অলাভজনক (দাতব্য) প্রতিষ্ঠানে অর্থ স্থানান্তর করেন। পরে তাদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে সেগুলো স্থানান্তর করা হয়।
মামলার অভিযোগে যা বলা হয়েছে
ডিটিপি এবং ডি২ এর কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন প্যাকেজের নামে ১০৫ দশিমিক ৩২ শতাংশ গড়ে মুনাফা দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ডেসটিনি মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করেছে। তাদের প্যাকেজগুলো হলো- গোল্ডেন প্যাকেজ , প্রিমিয়ার প্যাকেজ , ক্ল্যাসিক প্যাকেজ, সিলভার প্যাকেজ, সুপার সিলভার প্যাকেজ, সুপার গোল্ড প্যাকেজ । এ প্যাকেজ গুলো যারা নিয়েছে তাদেরকে বছর শেষে ৫০ হাজার টাকা ফেরত দিতে হবে।
দুদক জানায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ডেসটিনি ট্রি প্ল্যানটেশন ও ডেসটিনি মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটির মাধ্যমে প্রায় ৪ হাজার কোটি সংগ্রহ করে। কিন্তু বর্তমানে তাদের পৃথক দুটি অ্যাকাউন্টে ৫৬ লাখ ও ৪ কোটি ৮৭ লাখ টাকা পাওয়া গেছে। বাকি টাকা তারা মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছে।
দুদক জানায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড বিভিন্ন প্যাকেজের মাধ্যমে জনসাধারণের কাছ থেকে বিপুল পরিমান অর্থ সংগ্রহ করে কমিশন হিসেবে তা কর্মকর্তা ও এজেন্টরা ভাগাভাগি করে আত্মসাৎ করে। সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল হারুন এবং ডেসটিনির এমডি রফিকুল আমীন ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির আরো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে ডেসটিনির গ্রুপের ৩৭টি কোম্পানির আর্থিক অনিয়ম তদন্তে নামে দুর্নীতি দমন কমিশন। এ সংক্রান্ত তদন্ত কমিটির সমন্বয়ক দুদুক পরিচালক স্কয়াড্রন লিডার মোঃ তাহিদুল ইসলাম, উপ-পরিচালক মোজাহার আলী সরদার ও সহকারী পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম প্রাথমিক তদন্তে বিপুল পরিমাণ অর্থের অনিয়ম পান।
তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ডেসটিনি ট্রি প্লানটেশন লিমিটেড (ডিটিপিএল) কর্তৃপক্ষ সাধারণ জনগণ ও বিনিয়োগকারীদের অধিক লাভ দেখিয়ে প্রলুব্ধ করে মাল্টি লেভেল মার্কেটি (এমএলএম) পদ্ধতিতে ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেড অবৈধভাবে ৬ কোটি ১৮ লাখ ৬৩০টি গাছ ও পাওলোনিয়া ট্রি স্ট্যাম্প বিক্রি করে সর্বমোট ২ হাজার তিনশত ৩৫ কোটি ৭৪ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা সংগ্রহ করে। এরমধ্যে ডিটিপিএল কর্তৃপক্ষ মোট ৮১ লাখ ২৮ হাজার ৮০টি গাছ এবং ২১ হাজার পাওলোনিয়া ট্রি স্ট্যাম্প জনগণের মধ্যে সরবরাহ করে। তারা ৮১ লাখ ২৮ হাজার ৮০টি গাছ বিক্রি করে ২শ’ ৯৮ কোটি ৯৮ লাখ ১৬ হাজার টাকা এবং ২১ হাজারটি পাওলোনিয়া স্ট্যাম্প বিক্রি করে ১ কোটি১৯ লাখ টাকা সংগ্রহ করে। কিন্তু ডিটিপিএল কর্তৃপক্ষ এমএলএম পদ্ধতিতে গাছ বিক্রির বিধান না থাকা স্বত্ত্বেও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের মাধ্যমে ২০০৬ সালের ২১ মার্চ থেকে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতারণাপূর্বক আইন ও বিধিবিধান লঙ্গন করে গাছ বিক্রি করে জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে।
দুদক সুত্র আরো জানায় ,ডিটিপিএল কোম্পানির প্রতিষ্ঠালগ্নে ২০০৬ সালে সংঘস্মারকে এম এল এম পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যবসা করার কোন প্রবিধান ছিল না । কোম্পানীর সংঘ-স্মারকে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করার বিধান না থাকা সত্বেও ২১মার্চ ২০০৬ সালে ডিটিপিএল এবং ডি ২ কে কর্তৃপক্ষ অবৈধভাবে একটি চুক্তি স্মাক্ষর করে যে, ১০ হাজার টাকার ট্রি প্যাকেজ বিক্রি করলে ডি২কে এর কাছ থেকে কমিশন ও প্রমোশনাল খরচ বাবদ মোট ৩৮০০ টাকা পাবে এবং সে মতে ডি২ কমিশন ও খরচ কেটে রেখে অবশিষ্ট অর্থ সপ্তাহের মধ্যে ডিটিপিএলকে প্রদান করবে । অতঃপর ২৩ সেপ্টম্বর ২০০৬ সালে অবৈধভাবে অপর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে যে ৮হাজার টাকার ট্রি প্যাকেজ বিক্রি করে ডি২কে কমিশন ও প্রমোশনাল খরচ বাবদ মোট ৩৭৫৫ টাকা পাবে এবং সেমতে ডি২কে তার কমিশন কেটে রেখে অবশিষ্ট অর্থ এক সপ্তাহের মধ্যে ডিটিপিএল কে প্রদান করবে। কিন্তু অত্র চুক্তির বিষয়ে কর্তৃপক্ষ প্রতারণামুলক জণগণকে প্রতারিত করে গেছে ।ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন ও মাল্টিপারপাস ব্যবসা করার অনুমতি না থাকা সত্বেও তারা ২০০৬ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবৈধ্যভাবে এমএলএম পদ্ধতিতে ব্যবসা করে ।
দুদক সূত্র জানায়, ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের পরিচালকরা নিজ নিজ স্বার্থে বেতন-ভাতা, অনারিয়াম, ডিভিডেন্ট ও ইনসেন্টিভ এবং কমিশন গ্রহণের নামে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ করেন। এর মধ্যে লে. জেনারেল (অব.) হারুন-অর-রশিদের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ১৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে ৫ কোটি ৮৪ লাখ টাক। মোহাম্মদ রফিকুল আমীন ও ফারাহ দীবার ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ৮১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৭৩ কোটি ২৭ লাখ এবং স্থিতি আছে ৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসেনের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ১ কোটি ৯১ লাখ টাকা, উত্তোলন করেছেন ১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে মাত্র ১ লাখ টাকা।
পরিচালক সাঈদ-উর রহমানের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ১৭৩ কোটি ৭৩ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ১৬৭ কোটি ৪৪ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা। পরিচালক গোফরানুল হকের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ৮৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৮৩ কোটি ৪ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা। পরিচালক মেসবাহউদ্দিন স্বপনের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ৭৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৭৪ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে ৩ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।
পরিচালক নেপাল চন্দ্র বিশ্বাস ও মিতু রানী বিশ্বাসের ব্যক্তিগত ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ৩৪ কোটি টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৩৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে ৩২ লাখ টাকা। পরিচালক শেখ তৈয়বুর রহমান ও সেলিনা রহমানের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ৩৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৩০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাক। পরিচালক সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেনের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ১৬ কোটি ৫৮ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ১৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা এবং স্থিতি আছে মাত্র ৪৫ লাখ টাকা।
পরিচালক ইরফান আহমেদ সানীর ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ১ কোটি ৮ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ৭০ লাখ টাকা। পরিচালক জামসেদ আরা চৌধুরীর ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ২১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে ১৮ কোটি ২১ লাখ টাকা আর স্থিতি আছে ২ কোটি টাকা।
পরিচালক লে. কর্নেল (অব.) দিদারুল আলমের ব্যাংক হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে ২২ কোটি ৪২ লাখ টাকা, এর মধ্যে উত্তোলন করা হয়েছে জমার চেয়েও ১ কোটি ২৭ লাখ টাকা।
ডিটিপি এবং ডি ২ এর কর্তৃপক্ষ মোট ২ কোটি ৬৫ লাখ ৮৮ হাজার ৮৮৩টি প্যাকেজে মোট ৫ কোটি ৪৮ হাজার ৮৫ টি গাছ বিক্রি করে। ডিটিপিএল এর সংঘ স্মারকে এমএলএম বিধান না থাকা সত্বেও আইন লংঘন করার করে কথিত ও অবৈধ চুক্তির মাধ্যমে ডি২কে কর্তৃপক্ষ কমিশন ও প্রমোশনাল খরচের ছদ্দাবরণের জনগণের টাকা নিজের ব্যাংক হিসেবে স্থানান্তর করা হয়।
একইভাবে ডিটিপিএল কাছ থেকে ৮০ শতাংশ (জনগণ) এবং ২০ শতাংশ কোম্পানির লভ্যাংশে বন্টনের হারে পাওলোনিয়া ট্রি প্যাকেজ বিক্রি করেন ।