রাজধানীতে বেপরোয়াগতিতে বাড়ছে নারী অপরাধীর সংখ্যা। সচিবালয় থেকে শুরু করে বস্তি এলাকা পর্যন্ত অবাধ বিচরণ তাদের। নানা রকম অপরাধ করেও সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে এরা। দাপটের সঙ্গে আবার ঘটিয়ে চলছে অঘটন। ছিনতাই, ডাকাতি, চুরি, অপহরণ, প্রতারণা, অস্ত্র বহন, মাদক বিক্রি, মাদক বহন, মানুষকে অজ্ঞান করে সর্বস্ব কেড়ে নেয়া, তদবির বাণিজ্য, ম্যারেজ মিডিয়ার প্রতারণা, যৌন আবেদন দেখিয়ে প্রতারণা, পকেটমার, জাল টাকা বহন সহ বিভিন্ন ধরনের ভয়ঙ্কর সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে নারী। নারীকে দিয়ে অপরাধ সংঘটন অনেকটা সহজ বলে দিনে দিনে বেশি মাত্রায় নারীদের টানা হচ্ছে অপরাধ জগতে। পুলিশের অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে সামপ্রতিক সময়ে রাজধানীতে হাই সোসাইটির সুন্দরী মেয়েদের বেশি করে আগমন ঘটছে অপরাধ জগতে। এদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে প্রতারণা করে বিত্তবানদের কাছ থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়ার কাজে। তবে ওই সব নারীর পেছনে একটি সংঘবদ্ধ পুরুষচক্র সক্রিয় আছে।
সামপ্রতিক সময়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া বেশ কয়েকটি নারী অপরাধীর কাছ থেকে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে তাদের টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়া সহ খুনের মতো অপরাধে জড়িত ওই সব নারী। তাদের আছে একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। অপরাধ করেও ছাড়া পাওয়ার মতো শক্ত খুঁটি আছে তাদের, যোগাযোগ আছে প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে। ধরা পড়ার পরও এরা সহজে বেরিয়ে আসে।
ফরিদপুরের গ্রামের মেয়ে লিপি। জেলা শহরের একটি কলেজে পড়ার সময় মোবাইল ফোনে পরিচয় হয় ঢাকার জুরাইন এলাকার এক যুবকের সঙ্গে। পরিচয় থেকে গভীর প্রেম। পরিবারের অজান্তে গোপনে বিয়ে করে লিপি। শেষে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতের জালে। রাজধানীতে স্বামীকে সঙ্গে করে প্রবাসী পাত্রীর জন্য পাত্র যোগাড়ের ম্যারেজ মিডিয়া খুলে শুরু করে প্রতারণার ব্যবসা। প্রবাসী পাত্রী সেজে নিজেই কুড়িখানেক পাত্রের সঙ্গে বিয়ের অভিনয় করে, কোন কোন পাত্রের সঙ্গে অল্পদিনের জন্য সংসারও করে। পাত্রকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে চম্পট দেয় পাত্রের কাছ থেকে। অবশেষে র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে এখন কারাগারে আছে। গত আগস্ট মাসে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে রাজধানীর এক নারী অপরাধী চক্রের সদস্য। পুরুষ সহযোগী সহ ওই নারী অপরাধীর মূল টার্গেট ছিল সমাজের বিত্তবান লোকদেরকে ফাঁদে ফেলে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া। সুন্দরী এ নারীর টিমে দেখা গেছে একাধিক ক্যামেরাম্যান, ভিডিও ক্যামেরা সহ সংলাপ ধারণের জন্য উচ্চমানের ডিজিটাল টেপরেকর্ডার। ওই চক্রটি সমাজের উপর তলার লোকদের মোবাইল ফোন যোগাড় করে তাদের সঙ্গে প্রেমালাপের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠ হয়। তারপর যৌন কর্মের প্রস্তাব দিয়ে তাদের আস্তানায় নিয়ে জোর করে পুরুষ লোকটির নানা ধরনের আপত্তিকর ছবি তুলে, ভিডিও চিত্র ধারণ করে ব্ল্যাকমেইল করে। ওই চক্রটির খপ্পরে পড়ে কোটি টাকা খোয়াতে হয়েছে দেশব্যাপী পরিচিত এক ব্যবসায়ী নেতাকে। বিপুল পরিমাণ টাকা খুইয়েও তিনি চেপে গেছেন লোকলজ্জার ভয়ে। দেশের দক্ষিণাঞ্চল থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির একজন এমপিও পড়েছিলেন ওই নারী চক্রের খপ্পরে। তাকেও গুনতে হয়েছে বড় অঙ্কের টাকা। সামপ্রতিক সময়ে প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু বলে পরিচিত স্থানে সরকারের একজন পদস্থ ব্যক্তি এক সুন্দরী নারী তদবিরকারকের খপ্পরে পড়ে তার অনেক অবৈধ কাজ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন বলে গুঞ্জন আছে। ঢাকা শহরের কমপক্ষে আটটি স্পটে নারী ছিনতাইকারীদের দাপটের কথা জানে রাজধানীর মানুষ। প্রকাশ্যে বোরকা পরে ওই সব ছিনতাইকারীকে রুখতে পারছে না পুলিশ। বরং উল্টো পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে তাদেরকে সহযোগিতা করার। তাদের দাপটের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন ডিএমপি’র একজন পুলিশ কর্মকর্তা। অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত এক বছরে রাজধানীর বিভিন্ন স্পটে নারী ছিনতাইকারীদের সংখ্যা বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ঢাকা শহরে যে পরিমাণ মাদক প্রবেশ করে তার নব্বই ভাগের বহনকারী নারী, একই ভাবে মাদক বিক্রির ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে তাদের। গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সীমান্ত এলাকা গলিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগের বাহক নারী। অর্থের বিনিময়ে এরা আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে পৌঁছে দেয় গন্তব্যে। রাজধানী শহরে পুলিশের গোয়েন্দা তালিকায় আছে কয়েক ডজন মোস্ট ওয়ানটেড সুন্দরীর নাম। এদের আসল কাজ বিয়ে বাণিজ্য। কাঁচা টাকার মালিক বিত্তবানদের ব্ল্যাকমেইল করে বড় অঙ্কের টাকার কাবিন করে শেষে নানা অজুহাতে ঝগড়া বাধিয়ে কাবিননামার টাকা আদায় করা এদের কাজ। ওই চক্রটির একাধিক সুন্দরী কাজ করে শোবিজে। একজনকে ছেড়ে প্রতারণার মাধ্যমে আরেকজনকে বিয়ে করে আবার কাবিননামায় উল্লেখ করা টাকা হাতিয়ে নেয় এরা। সামপ্রতিককালে ইউনিপেটুইউ নামের প্রতারক প্রতিষ্ঠানের এমডি মুনতাসীর ইমন এমনি এক বিয়ে প্রতারক সুন্দরীর খপ্পরে পড়ে খুইয়েছেন প্রায় আট কোটি টাকা।
রাজধানী শহরের বিভিন্ন বাসাবাড়িতে ডাকাতি ও স্বর্ণ চুরির অপরাধী চক্র ব্যবহার করছে বাসা বাড়ির বুয়াদের। ওই সব বুয়া বাসা বাড়িতে কাজ নেয় আসলে বাড়িতে ডাকাতি করার উদ্দেশে। এরা কাজ করার ফাঁকে খোঁজ নেয় বাড়ির কোন কোন স্থানে স্বর্ণ সহ নগদ টাকা রাখা হয়। কাজের বুয়া হিসেবে মালিকের বিশ্বস্ততা অর্জন করে লুকিয়ে বাসার চাবি সাবানের ওপর ছাপ দিয়ে বাইরে এনে তৈরি করে ডুপ্লিকেট চাবি। বাসার মালিক বাইরে গেলে সুযোগ বুঝে পুরুষ সহযোগীদের খবর দিয়ে এনে ডাকাতি করে বাড়িতে। ইতিপূর্বে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে জাল টাকা বহনকারী একাধিক নারী। পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, প্রতিটি জাল টাকার চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে একাধিক নারী সদস্য। এছাড়া পুরুষ পকেটমারের মতোই এখন রাজধানীতে বিচরণ করছে কয়েক ডজন নারী পকেটমার। তবে ঈদ সহ বাজারে বেশি জনসমাগমের পার্বণগুলোতে বেশি মাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে নারী পকেটমার।
সামপ্রতিক সময়ে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে নারীদের বেশি মাত্রায় জড়িত হওয়ার বিষয়ে ডিএমপি’র মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন শাখার ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, নারীদেরকে সাধারণত কেউ তেমন সন্দেহ করে না বলেই একটি চক্র নারীদেরকে অপরাধ জগতে টেনে আনছে, যাতে তাদেরকে দিয়ে নির্বিঘ্নে অপরাধ ঘটানো যায়। তবে তিনি নারী অপরাধী বৃদ্ধি পাওয়ার বিষয়ে একমত পোষণ করেননি। তিনি বলেন, জাল টাকার বাহক সহ পকেটমার, মাদক বিক্রি সহ অন্য কিছু অপরাধের ক্ষেত্রে রাজধানীতে নারী সদস্যরা সক্রিয় আছে।