ঢাকা, ১৫ নভেম্বর : রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জে স্কুলছাত্র পরাগ মন্ডল অপহরণে জড়িত থাকার অভিযোগে র্যাব ৭ জনকে আটক করেছে।
এ অপহরণের রহস্য উদঘাটন করার দাবি জানালেও র্যাব বলছে, এর মূল পরিকল্পনাকারী আমির হোসেন ওরফে ল্যাংড়া আমির এবং তার আরো দুই সহযোগী এখনো পলাতক। তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে র্যাব সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে লিগ্যাল ও মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ সোয়াহেল একথা জানান।
মোহাম্মদ সোয়াহেল জানান, এ অপহরণের পেছনে অন্য কোনো কারণ রয়েছে কিনা তা জানা যাবে মূল হোতা আমির হোসেনকে গ্রেফতার করার পর। তিনি আরো জানান, মুক্তিপণের ৫০ লাখ টাকা আমিরের কাছে।
বুধবার রাতে আটক ৭ জনকে এ সময় সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলো অপহরণের নেতৃত্বদানকারী আমিরের ভগ্নিপতি আবুল কাশেম (৩৬), দনিয়া কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক ২য় বর্ষের ছাত্র জাহিদুল হাসান, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ভাড়াটিয়া কিলার কালাচান (৩৫), উত্তরার এরোনটিক্যাল ইন্সটিটিউটের ছাত্র আলী রিফাত (১৯), তার বন্ধু রিজভী আহমেদ অনিক (১৯), আলফাজ হোসেন ও একটি রেষ্টুরেন্টের বেয়ারা মাসুদ (২৩)। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে ঘটনার দিন অপহরণ কাজে ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করেছে।
তারা পৃথকভাবে অপহরণের ঘটনার বর্ণনা এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেয়।
যেভাবে অপহরণ হন পরাণ
ঘটনার পরপরই র্যাবের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর রহস্য উদ্ঘাটনে মাঠে নামে। এ অপহরণ মামলার তদন্তের শুরুতেই চাঞ্চল্যকর বিভিন্ন তথ্য উদ্ঘাটিত হতে থাকে। ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত আমির এক মাস আগে জেল থেকে ছাড়া পেয়েই এই অপহরণের পরিকল্পনা শুরু করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শুভাঢ্যা এলাকার সিএনজিচালক ও তার সঙ্গে অন্যান্য বিভিন্ন অপকর্মে অংশ গ্রহণকারী মো. কালাচানের সঙ্গে আলোচনা করে। কাজের পারিশ্রমিক হিসাবে কালাচানকে একটি নতুন সিএনজি কিনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
ঘটনার আগে থেকেই কালাচান বিমল মন্ডলের বাড়ির সামনের স্থান এবং বাচ্চাদের স্কুলের সময়সূচি পর্যবেক্ষণ করে আমিরকে জানায়।
ঘটনার দিন আমির, তার ড্রাইভার এবং অন্য দুই হোতা মোঃ জাহিদুল হাসান এবং মোঃ আলী রিফাত অপহরণস্থলে মিলিত হয়। কালাচানকে সিএনজিসহ চুনকুটিয়া চৌরাস্তা এলাকা পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় আমির। পরে আমির এবং মোঃ জাহিদুল হাসান তাদের দুই সহযোগীসহ দুটি মোটরসাহকেলযোগে বিমল মন্ডলের বাড়ির সামনে গাড়িতে উঠার স্থানে ওঁৎ পেতে থাকে।
বিমল মন্ডলের স্ত্রী লিপি মন্ডল যখন তার দুই মেয়ে দিয়া মন্ডল, পিনাকি মন্ডল এবং ছেলে পরাগ মন্ডলকে নিয়ে স্কুলের যাওয়ার জন্য গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়ায় তখন অপহরণকারীরা গাড়ির ড্রাইভারকে গাড়ির চাবি দেয়ার জন্য চাপ দিতে থাকে এবং তার ছেলেকে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। এমতবস্থায় লিপি মন্ডল তার ছেলেকে টেনে ধরে রাখার চেষ্টা করার সময় অপহরণকারীরা লিপি মন্ডল এবং ড্রাইভার নজরুল ইসলামের পায়ে গুলি করে।
এ অবস্থা দেখে ছোট মেয়ে পিনাকী মন্ডল চিৎকার শুরু করলে অপহরণকারীরা তার পায়েও গুলি করে এবং পরাগ মন্ডলকে মোটরসাইকেলে মো. আলামিন এবং আমিরের মাঝখানে বসিয়ে নিয়ে যেতে উদ্যত হয়। ছেলেকে রক্ষার জন্য মা লিপি মন্ডল অপহরণকারীদের দিকে হতে চাইলে অপহরণকারীরা তার বুকে এক রাউন্ড এবং উপরের দিকে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে পরাগ মন্ডলকে নিয়ে দ্রুত ঘটনাস্থল ত্যগ করে। আমির এবং আলামিন একটি মোটরসাইকেল যোগে অপহৃত শিশু পরাগ মন্ডলকে নিয়ে কেরানীগঞ্জের কোনাখোলার দিকে চলে যায় এবং অন্য দুই অপহরণকারী মো. জাহিদুল হাসান এবং মো. রিফাত অন্য একটি মোটরসাইকেলযোগে তাদের নিজ নিজ বাসা জুরাইন এবং ইকুরিয়া চলে যায়।
এরপর থেকেই র্যাব এ চাঞ্চল্যকর অপহরণকারীদের গ্রেফতারের জন্য অভিযান শুরু করে।
আটকদের মধ্যে রিফাত, জাহিদুল ও কালাচান এ অপহরণের পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে র্যাব।
র্যাব-১০ বুধবার গভীর রাতে তাদের রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে আটক করা হয়।
যুবলীগের স্থানীয় নেতারা এর সঙ্গে জড়িত কিনা এমন জবাবে র্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান জানান, আমির হোসেনকে গ্রেফতারের পর জানা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত যুবলীগের কোনো সম্পৃক্তার কথা জানা যায়নি।
এ ঘটনায় বুধবার বিকালে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা পুলিশ সিরাজদিখানের নিমতলি এলাকা থেকে মামুন (৪৫) নামের একজনকে গ্রেফতার করে।
গত রোববার সকাল ৭টার দিকে রাজধানীর উপকণ্ঠ কেরানীগঞ্জের শুভাঢ্যা পশ্চিমপাড়ায় তার মা, বোন ও গাড়িচালককে গুলি করে ছয় বছরের শিশু পরাগকে অপহরণ করে মোটরসাইকেল আরোহী কয়েকজন অপহরণকারী। ঘটনার পর থেকেই তাকে উদ্ধারে অভিযান শুরু করে পুলিশ ও র্যাব।
এদিকে এ ঘটনার পরপরই কেরানীগঞ্জে পরাগের বাসায় শোকের ছায়া বিরাজ করতে থাকে। এলাকাবাসীর মধ্যেও এ শোক ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়াও ওই এলাকার স্কুল ছাত্র-ছাত্রীদের অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ঘটনার পর পরই গুলিতে আহতদের প্রথমে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে অবস্থার অবনতি ঘটলে পরাগের মা লিপি মন্ডলকে রাজধানীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয় এবং সখানে তার অস্ত্রোপচার করা হয়।
পরাগের বোন পিনাকিকে রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় রোববার রাতেই পরাগের দাদি সাবিত্রী মন্ডল বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা চার ব্যক্তিকে আসামি করে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় হত্যা চেষ্টা ও অপহরণের অভিযোগ আনা হয়।
ব্যাবসায়ী বিমল মন্ডলের তিন সন্তানের মধ্যে ছোট ছেলে পরাগ বাংলাবাজারের হিড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী পরাগের বোন পিনাকি।আরেক বোন পিয়ালি সানফ্রান্সিসকো ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী।
মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেছিলেন পরাগের অপহৃত হওয়া বিষয়টি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তিনি বলেছিলেন, অপহৃত পরাগকে যেকোনো মুহূর্তে উদ্ধার করা সম্ভব। কেননা ঘটনাটিকে তদন্ত করে শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।