বার্তা৭১ ডটকমঃ সুদের হার ঠিক না হওয়ায় পদ্মা সেতুকে সংযোগকারী নতুন রেল লাইন নির্মাণ ও কর্ণফুলী নদীর নিচে টানেল নির্মাণসহ নয়টি প্রকল্পে চীনের সাড়ে সাতশ কোটি ডলারের ঋণ প্রস্তাব এখনো ঝুলে আছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে সুদের হার বেশি হওয়ায় এতদিন চীনা ঋণ গ্রহণ করতে পারছিল না সরকার।
তিন শতাংশের বেশি সুদের পুরোনো চীনা ঋণের জায়গায় সম্প্রতি চীনা দূতাবাস দুই শতাংশ হারে সুদ চেয়ে ৭৪৮ কোটি ডলারের ঋণের প্রস্তাব অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার প্রস্তাবিত দুই শতাংশ সুদ কমিয়ে দেড় শতাংশ করতে পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে দর কষাকষি করছে।
এর আগে গত বছর চীন সরকারের অর্থায়ন চেয়ে ১০টি প্রকল্পের একটি তালিকা পাঠায় বাংলাদেশ। ওই তালিকা থেকে বাছাই করে প্রায় ৯৪০ কোটি ডলার ব্যয়ের নয়টি প্রকল্পে ৭৪৮ কোটি ডলার অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করে চীন।
ইআরডির এশিয়া উইংয়ের অতিরিক্ত সচিব আসিফ-উজ-জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীন সরকার বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থায়নের প্রস্তাব করেছে। নমনীয় হারে সুদের কথা বলা হলেও তা ২ শতাংশ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
“কিন্তু অর্থমন্ত্রী তা দেড় শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন। চীন সরকার এখনো তাদের অবস্থান পরিস্কার করেনি।”
এর মধ্যে প্রস্তাবিত নয় প্রকল্পের একটি ‘চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল’ নির্মাণে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি সই হয়েছে।
জুনের শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশের সেতু বিভাগ ও চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত নির্মাতা প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (সিসিসিসি) মধ্যে ৭০ কোটি ৫০ লাখ ডলারের এই ঋণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে ঋণের সুদহার কত হবে তা নির্ধারণ করা হয়নি।
ইআরডি কর্মকর্তারা জানান, বাণিজ্যিক চুক্তি হওয়ার পরও আর্থিক চুক্তি হতে কমপক্ষে ছয় মাস সময়ের প্রয়োজন হয়। এই সময়ের মধ্যে সুদহার নিয়ে দর কষাকষি চলতে থাকবে।
ইআরডির জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চীন যেসব প্রকল্পে অর্থায়ন করে সেসব প্রকল্পে আন্তর্জাতিক দরপত্র ছাড়াই দেশটির পণ্য ও সেবা ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক থাকে। এ প্রক্রিয়ায় পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আশঙ্কা থাকে। তাই বাংলাদেশ সরকার চিন্তা-ভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।”
তবে একক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হলে আলোচনার ভিত্তিতে ‘তুলনামূলক কম সময়ে পণ্য ক্রয়’সহ নানা ধরনের জটিলতা থেকে রেহাই পাওয়া যায় বলে মনে করেন তিনি।
চীন সরকার উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সহযোগী হলেও ২০১৩ সালের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির কোনো ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। এর আগে চীনের সঙ্গে সর্বশেষ ঋণচুক্তি ছিল চলমান ‘পদ্মা জশলদিয়া ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট স্থাপন’ প্রকল্পে।
দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল বাংলাদেশ। বর্ধিত ঋণ সুবিধা (ইসিএফ) নামের ওই ঋণ তিন বছরের মধ্যে সাত কিস্তিতে পরিশোধের কথা।
১৯টি শর্ত মেনে বাংলাদেশ ওই ঋণ নিয়েছিল, যার মধ্যে অন্যতম প্রধান শর্ত ছিল যে কোনো দাতা দেশ বা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে ৩৫ শতাংশের বেশি গ্রান্ট এলিমেন্ট থাকতে হবে। সুদের হার, রেয়াত কাল ও পরিশোধের মেয়াদ হিসাব করে গ্রান্ট এলিমেন্ট ধরা হয়। আইএমএফের ওই শর্ত অনুযায়ী বিশ্ব ব্যাংক, জাইকা ও এডিবির ঋণ ৩৫ শতাংশের বেশি গ্রান্ট এলিমেন্ট থাকে।
আইএমএফের ওই শর্ত মানতে গিয়ে এরপর থেকে বাংলাদেশ চীনের কাছ থেকে আগের মতো ঋণ নিতে পারেনি। মূলত একারণেই ২০১৩ সালের পর চীনের সঙ্গে আর কোনো ঋণ চুক্তি করা সম্ভব হয়নি।
ইআরডির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পদ্মা সেতুতে রেল লাইন স্থাপনে দুই পর্যায়ে ৩৩৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার ব্যয়ে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নে চীন ২৫৭ কোটি ৫৭ লাখ ডলার ঋণ দিতে রাজি।
অন্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে- ‘ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় ১৭৫ কোটি ডলারের মধ্যে ১৩৯ কোটি ৩৯ লাখ ডলার দেওয়ার প্রস্তাব করেছে চীন।
‘জয়দেবপুর থেকে ঈশ্বরদী পর্যন্ত দ্বৈত রেল লাইন স্থাপন’ প্রকল্পে ৭৫ কোটি ২৭ লাখ ডলার এবং জয়দেবপুর -ময়মনসিংহ মিটার গেজ রেল লাইনের পাশাপাশি সমান্তরাল আরেকটি ব্রড গেজ লাইনে উন্নীতকরণে ২৫ কোটি ৮৩ লাখ ডলার ঋণ প্রস্তাব রয়েছে।
এছাড়াও সরকারি পাটকল আধুনিকায়নে ২৮ কোটি ডলার, পিজিসিবির পাওয়া গ্রীড নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করণে ১৩২ কোটি ডলার এবং টেলি কমিউনিকেশনস লাইন আধুনিকায়নে ২০ কোটি ডলার সরকারি ঋণ প্রস্তাব দিয়েছে দেশটি।
এসব প্রকল্পের জন্য দুই সরকারের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক চুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করেছে চীন সরকার।