বার্তা৭১ ডটকমঃ একাত্তরে রাজাকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে বর্বরতার জন্য বাগেরহাটের মানুষ যার নাম দিয়েছিল ‘কসাই সিরাজ’, সেই শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টারের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে হত্যা ও গণহত্যার পাঁচ অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায়।
আদালত বলেছে, অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় সিরাজ মাস্টারের মৃত্যুদণ্ড না হলে ‘ন্যায়বিচার হত না’।
একই মামলায় মুক্তিযোদ্ধা হত্যায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় বাগেরহাটের আরেক রাজাকার খান আকরাম হোসেনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করে।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন এ মামলায় মোট সাতটি অভিযোগ এসেছিল আসামিদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে প্রথম ছয়টিতে আসামি ছিলেন সিরাজ। আর আকরাম আসামি ছিলেন ৫, ৬ ও ৭ নম্বর অভিযোগে।
আদালতের রায়ে ১ থেকে ৫ নম্বর অভিযোগের প্রতিটিতে হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের মতো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে সিরাজকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে, অথবা গুলি করে সিরাজ মাস্টারের দণ্ড কার্যকর করতে বলেছে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল। কীভাবে রায় কার্যকর হবে সে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।
অভিযোগ ১: ১৯৭১ সালের ১৩ মে দুপুর ২টার দিকে রাজাকার বাহিনীর বাগেরহাট সাব ডিভিশনের তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার শেখ সিরাজুল হক ওরফে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৫০-৬০ জন রাজাকার এবং বেশ কিছু স্বাধীনতাবিরোধী বাগেরহাট জেলার রঞ্জিতপুর গ্রামে ঘিরে ফেলে। তারা বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। ওই সময় সিরাজুল হক এবং তার সহযোগীরা প্রায় ৪০-৫০ জন হিন্দুকে হত্যা করে।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টার গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্রিসংযোগসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন।
অভিযোগ ২: স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে বাগেরহাট জেলার রামপাল থানার ডাকরার কালী মন্দিরে ভারতের শরণার্থী শিবিরে যাওয়ার জন্য জড়ো হয় হিন্দু সম্প্রদায়ের দুই-তিন হাজার লোক। এ খবর পেয়ে তাদের হত্যার জন্য সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ৪০-৫০জন সশস্ত্র রাজাকার ডাকরা গ্রামে যায় এবং নির্বিচারে গুলি চালায়।
এরপর কালী মন্দিরে গিয়ে সেখানে জড়ো হওয়ার মানুষদের ওপর সশস্ত্র হামলা চালিয়ে ছয় থেকে সাতশ জনকে হত্যা করে তারা। ১৯৭১ সালের ২১ মে বেলা ৩টা থেকে ৫টার মধ্যে এ ঘটনা ঘটে। সে সময় সিরাজ মাস্টার ও সহযোগীরা ওই এলাকার বিভিন্ন বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টার গণহত্যা, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের অভিযোগে দোষী প্রমাণিত হয়েছেন।
অভিযোগ ৩: একাত্তরের ১৮ জুন সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টারের নেতৃত্বে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সেনা সদস্য এবং ৩০-৩৫ জন সশস্ত্র রাজাকার বেসরগাতী, কান্দাপাড়া গ্রাম এবং কান্দাপাড়া বাজার থেকে ২০ জনকে অপহরণ করে। তাদের কান্দাপাড়া বাজারে আটকে রেখে নির্যাতন চালায় সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা। তাদের নির্যাতনে ১৯ জন নিহত হন। অপহৃত শেখ সুলতান আলী ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান, যিনি পরে ১৯৮৪ সালে মারা যান।
এ ঘটনায় খুন, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সিরাজ মাস্টার।
রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী শেখ সিরাজুল হককে তোলা হচ্ছে প্রিজন ভ্যানে। রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী শেখ সিরাজুল হককে তোলা হচ্ছে প্রিজন ভ্যানে। রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী খান আকরাম হোসেনকে তোলা হচ্ছে প্রিজন ভ্যানে। রায়ের পর যুদ্ধাপরাধী খান আকরাম হোসেনকে তোলা হচ্ছে প্রিজন ভ্যানে।
অভিযোগ ৪: একাত্তরের ১৪ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে সিরাজ মাস্টার ও রজব আলী ফকিরের নেতৃত্বে ১০০-১৫০ জন সশস্ত্র রাজাকার সদর থানার চূলকাঠি গ্রাম, চুলকাঠি বাজার, গণশেমপুর ও আশপাশের এলাকায় হামলা করে এবং প্রায় ৪২টি বাড়িতে লুটপাট চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। এরপর সিরাজ মাস্টার ও তার সহযোগীরা ওইসব এলাকা থেকে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ করে তাদেরকে চুলকাঠি বাজারে আটকে রাখে। পরে তাদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টারের বিরুদ্ধে হত্যা, অপহরণ, আটকে রেখে নির্যাতনসহ অন্যান্য অমানবিক কাজের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে।
অভিযোগ ৫: মুক্তিযুদ্ধের সময় ৫ নভেম্বর দুপুর ৩টার দিকে সিরাজ মাস্টার, স্থানীয় রাজাকার নেতা খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদারসহ ৫০-৬০জন রাজাকার সদস্য মিলে কচুয়া থানার শাঁখারিকাঠি হাটে হামলা চালায়। সেখানে তারা ৪০ জন হিন্দু এবং দুই স্বাধীনতা সমর্থককে আটক করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে এবং গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনায় সিরাজ মাস্টার অপহরণ, হত্যাসহ অন্যান্য মানবতাবিরোধী অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলেও আকরামকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অপরাধ প্রমাণিত না হওয়ায় ৬ নম্বর অভিযোগ থেকে খালাস পেয়েছেন আকরাম ও সিরাজ মাস্টার। পাঁচজনকে অপহরণ করে কচুয়া সদরের রাজাকার ক্যাম্পে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল এ ঘটনায়।
দুটি অভিযোগে খালাস পেলেও ৭ নম্বর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় ৬০ বছর বয়সী আকরামকে বাকি জীবন কাটাতে হবে কারাগারে।
অভিযোগ ৭: মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ১৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টার দিকে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান শিকদার অন্য চার মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে ভাটখলি ক্যাম্প থেকে বাড়ির দিকে যাওয়ার সময় মোড়েলগঞ্জ থানার তেলিগাতীতে খান আকরাম হোসেন ও আবদুল লতিফ তালুকদারসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যদের হাতে আটক হন। তারা মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানের ওপর নির্যাতন চালায় এবং নদীর কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে।
এ ঘটনায় অপহরণ ও হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন খান আকরাম হোসেন।
সিরাজুল হক ও খান আকরাম হোসেনের সঙ্গে এ মামলায় আব্দুল লতিফ তালুকদার (৭৫) নামে আরেক রাজাকার সদস্য অভিযুক্ত হন। কিন্তু রায়ের আগেই গত ২৭ জুলাই বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় মৃত্যু হওয়ায় তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।