বার্তা৭১ ডটকমঃ
পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের ১৯ বছর পূর্তি আজ। দিবসটি ঘিরে পার্বত্য অঞ্চলে আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, ও পার্বত্য জেলা পরিষদ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা না করা নিয়ে পাহাড়িদের মাঝে যেমন রয়েছে হতাশা, তেমনি পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের মাঝে চুক্তি বাস্তবায়ন নিয়ে রয়েছে প্রবল বিরোধিতা। আজ বিবদমান গ্রুপগুলো পাল্টাপাল্টি কর্মর্সূচি ঘোষণা করেছে।
আজ থেকে ১৯ বছর আগে বাংলাদেশ সরকার এবং জনসংহতি সমিতির মধ্যে দীর্ঘ সংলাপের পর স্বাক্ষরিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি,যা সাধারণভাবে শান্তি চুক্তি নামেই পরিচিত। এই চুক্তির মাধ্যমেই দীর্ঘ ২৪ বছরের সশস্ত্র লড়াই শেষে অস্ত্রসমর্পণ করে শান্তি বাহিনীর প্রায় দুই হাজার গেরিলা। নানা শর্তে আর সুযোগ সুবিধার আশ্বাসে এই গেরিলারা অস্ত্র ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও সরকারের বিরুদ্ধে এখন প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের অভিযোগ আনছে এ গেরিলাদের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে বরাবরই দাবি করা হয়, প্রতিশ্রুত শান্তি চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। আর ভূমি সমস্যাসহ বাকী যে সামান্য অংশ অবাস্তবায়িত রয়েছে তা বাস্তবায়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আবার পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালিদের একটি বড় অংশই এই চুক্তিকে নিজেদের অধিকার হারানোর দলিল মনে করে। তারা শুরু থেকেই এ চুক্তির সরাসরি বিরোধিতা করে বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা মনে করছেন এ চুক্তিতে শুধুমাত্র পাহাড়িদের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হলেও বাঙালিদের কথা চিন্তা করা হয়নি।
তৎকালীন ও বর্তমান ক্ষতাসীন দল আওয়ামী লীগ সরকার ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পাহাড়ের বিরাজমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করতে শান্তি বাহিনী নামক আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) প্রধান সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমার সাথে পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করে।
তখন চিরস্থায়ী শান্তির আশায় বুক বেধেছিল পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসকারীরা। কিন্তু চুক্তির ১৯ বছর পরেও পাহাড়ে থামেনি অস্ত্রের ঝনঝনানি। এখনও মাঝে মাঝে গোলাগুলির শব্দে গভীর রাতে ঘুম ভাঙ্গে এখানকার মানুষের। সশস্ত্র সংঘর্ষে পড়ছে লাশ, অপহরণ, ঘটছে চাঁদাবাজির ঘটনা।
অব্যাহত রয়েছে উপজাতীয় সন্ত্রাসী বাহিনীগুলোর আধিপত্য বিস্তারের লড়াই। থেমে নেই পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল (সন্তু লামার গ্রুপ) পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা গ্রুপ) সংস্কারপন্থী ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামের সংগঠনগুলোর কর্মকাণ্ড।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-তথ্য প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, ১৯ বছর আগে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এখনও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হয়নি। এখানকার সমস্যা একটা রাজনৈতিক সমস্যা। এ চুক্তি যদি বাস্তবায়ন না হয় তাহলে সমস্যা রয়ে যাবে। আমি মনে করি এখানে ভূমি বিরোধের যে সমস্যাটি রয়েছে ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করার মধ্য দিয়ে সে সমস্যার সমাধান করতে হবে।
অপরদিকে, পার্বত্য বাঙালি ছাত্র পরিষদের সভাপতি সাব্বির আহম্মেদ বলেন, চুক্তি বাতিলের জন্য আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। চুক্তি বাতিল না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাবো। এ চুক্তি একটি গোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য করা হয়েছে। এখানে যে বাঙালি গোষ্ঠীগুলো আছে কিভাবে তাদের সমস্যার সমাধান হবে বা তারা যে অধিকার থেকে বঞ্চিত সেখান থেকে কিভাবে উত্তরণ হওয়া যায় তার কোন কিছু উল্লেখ নেই চুক্তিতে।
এদিকে, সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অধিকাংশই বাস্তবায়িত হয়েছে। জনসংহতি সমিতি বলছে- চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি এটা তাদের রাজনৈতিক কৌশল। তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক জায়গায় শান্তি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এত দ্রুত কোথাও শান্তি চুক্তি বাস্তবায়িত হয়নি। তারা বলতে পারেন চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়িত হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। পাহাড়ে যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ছিল তা থেকে আমরা মুক্তি পেয়েছি। পাহাড়ে এখন শান্তির সুবাতাস বইছে উন্নয়নের জোয়ার চারিদিকে। এখানে মেডিকেল কলেজ, প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে শান্তি চুক্তির পরে। ভূমি বিরোধ নিষ্পক্তি কমিশন সম্পর্কে ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, বিভিন্ন সময়ে ভূমি কমিশন গঠন করা হয়েছে কিন্তু সে কমিশন তারা মেনে নেয়নি। এবার নতুন করে আবারও ভূমি বিরোধ নিষ্পক্তি কমিশন গঠন হয়েছে সেটিতে তারা সম্মতি দিয়েছে এবং কমিশনের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আশা করি অচিরেই এ সমস্যার সমাধান হবে।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ চেয়ারম্যান ও জনসংহতি সমিতির সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা (সন্তু লারমা) সম্প্রতি ঢাকায় সাংবাদিকদের বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এরশাদ সরকার, খালেদা জিয়ার সরকার এবং শেখ হাসিনার সরকারের সাথে দীর্ঘ ২৬টি বৈঠকের পর ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
আজ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির দীর্ঘ ১৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের কার্যাবলী হস্তান্তর; পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ; অপারেশন উত্তরণসহ অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার; ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তিকরণ, ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তুদের স্ব-স্ব জায়গা-জমি প্রত্যর্পণসহ পুনর্বাসন; পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল চাকুরিতে জুম্মদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়োগ, চুক্তির সাথে সঙ্গতি বিধানকল্পে পুলিশ এ্যাক্ট, পুলিশ রেগুলেশন ও ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিসহ পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রযোজ্য অন্যান্য আইন সংশোধন; সেটেলার বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইরে সম্মানজনক পুনর্বাসন ইত্যাদি চুক্তির মৌলিক বিষয়সমূহ এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
অন্যদিকে দেশ বিদেশের জনমতকে বিভ্রান্ত করতে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ৭২ টি ধারার মধ্যে ৪৮ টি ধারা ইতিমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে বলে অসত্য বক্তব্য প্রচার করে আসছে। বস্তুত ৭২ টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে। চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারের এ দায়সারা উদ্যোগ, চুক্তির অবাস্তবায়িত মৌলিক বিষয়সমূহ বাস্তবায়নে গড়িমসি, চুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে অসত্য তথ্য প্রচার ইত্যাদি থেকে প্রমাণিত হয় যে, সরকার জুম্ম জনগণসহ পার্বত্যবাসীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় চরমভাবে অনাগ্রহী।
এমতাবস্থায় পার্বত্যবাসীরা, বিশেষত জুম্ম জনগণ নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত এক চরম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে কঠিন জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যা রাজনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের ক্ষেত্রে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই জানান সন্তু লারমা। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির যথাযথ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পার্বত্যবাসীকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি কর্তৃক পূর্ব-ঘোষিত দশদফা কর্মসূচির ভিত্তিতে অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাবেন বলেও ঘোষণা করেন।
সাংবাদিকদের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির আলোকে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করা হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়নে প্রশাসন কর্তৃক আইনত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিকফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সদস্য সচিব চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ১৯ বছরপূর্তি উপলক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে পার্বত্য চুক্তি নিয়ে তামাশা বন্ধ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মৌলিক দাবিগুলো পূরণের মাধ্যমে এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়েছেন।
রাঙামাটিতে আজকের কর্মসূচি: পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির উদ্যোগে আজ সকাল ১০টায় রাঙামাটি জিমনেসিয়াম প্রাঙ্গণে গণসমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। গণসমাবেশে জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও নাগরিক সমাজের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ বক্তব্য রাখবেন। এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ তিন পার্বত্য জেলার বিভিন্ন স্থানে জনসংহতি সমিতি ও নাগরিক সমাজের উদ্যোগে নানা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।
এদিকে, রাঙামাটি জেলা পার্বত্য জেলা পরিষদের উদ্যোগে আজ সকালে রাঙামাটি পৌর চত্বর থেকে র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদিকে, বাঙালি সংগঠনগুলো বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে।