চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলনের কৌশল খুঁজছে বিএনপি। দু’দফায় টানা ৫ দিন হরতালের ‘মারণাস্ত্র’ ব্যবহারের পর আপাতত এ পথে আর হাঁটছে না। নতুন ধরনের কি কর্মসূচি দেয়া যায় ভাবছে। হরতাল, ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বিপক্ষে কথা বলেছেন হিলারি ক্লিনটন। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, খেটে খাওয়া মানুষ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষের মধ্যে হরতালবিরোধী মনোভাব তীব্রতর হয়েছে। অবশ্য বিরোধী দলের ইলিয়াস ইস্যুকেন্দ্রিক আন্দোলনে মানুষের সহানুভূতি রয়েছে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া বিবেচনায় নিয়ে বিএনপি আপাতত হরতাল না দিয়ে গণঅনশনে যাওয়ার প্রস্তাব গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দসহ সকল স্তরের নেতা-কর্মীরা এ অনশনে অংশ নেবেন। গণসংযোগ, গণমিছিল, গণঅবস্থান কর্মসূচি নিয়েও ভাবা হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ এসব কর্মসূচির মাধ্যমে জনমত নিরঙ্কুশভাবে পক্ষে টানা যাবে বলেই বিএনপির নেতৃবৃন্দ আস্থাশীল।
কেন্দ্রীয় নেতা ইলিয়াস আলী নিখোঁজ ইস্যুতে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক অঙ্গন। তাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে দু’দফায় টানা ৫ দিন হরতাল করেছে বিরোধী দল। ফলে ইলিয়াস ইস্যুতে গৌণ হয়ে পড়ে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সরকারকে দেয়া মধ্য জুনের আলটিমেটাম। তখন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে সারা দেশের বিএনপিসহ ১৮দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। রাজনৈতিক নেতা গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সুশীল সমাজসহ আন্তর্জাতিক মহল। আতঙ্কিত জনগণও বিএনপির সে আন্দোলনে নৈতিক সমর্থন দেয়। কিন্তু হঠাৎ করেই সে আন্দোলনে পিছুটান দেয় বিরোধী দল। হরতালে গাড়ি ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের দু’টি মামলায় আত্মগোপনে চলে যান নেতারা। এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায় রাজনৈতিক মহলে। নেতা-কর্মীদের মধ্যে নেমে আসে হতাশা। কিন্তু পুরো বিষয়টিকেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছে বিরোধী দল। আন্দোলনকে ফের চাঙা করতে অনশন, গণসংযোগ ও সমাবেশসহ নতুন ধারার কর্মসূচি প্রণয়নে নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছেন জোটের শরিকদলগুলো।
বিএনপি নেতারা জানান, চলমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই বাংলাদেশ সফরে এসেছেন গুরুত্বপূর্ণ তিন বিদেশী অতিথি। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় ও জাপানের উপ-প্রধানমন্ত্রী কাৎসুইয়া ওকাদা। কড়া কর্মসূচির ঘেরাটোপে থেকে তাদের আগমনে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চায়নি বিরোধী দল। এছাড়া উচ্চ আদালতের ওপর ভরসা রাখতে চেয়েছেন তারা। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত বিচার পাওয়া যায়নি। ফলে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সফররত এ তিন গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী নেতার বৈঠকে অংশ নিতে পারেননি বিএনপির সিনিয়র নেতারা। এতে বিদেশী অতিথিরা সরকারের বিরোধী দল দমন ও উচ্চ আদালতের আচরণ প্রত্যক্ষ করে গেছেন। তাতে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তারা স্বচ্ছ ধারণা পেয়েছেন। এটা সরকারের বিপক্ষে গেছে।
এদিকে নেতাদের মামলা জটিলতার কারণে কিছুটা আড়ালে চলে গেছে ইলিয়াস ইস্যু। সপ্তাহখানেক ধরে এ ইস্যুকে ছাড়িয়ে মুখ্য হয়ে উঠেছে নেতাদের মামলা ইস্যু। তবে উচ্চ আদালত থেকে এক সপ্তাহের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন পেয়েই ইলিয়াস ইস্যুতে আন্দোলন অব্যাহত রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই জটিল হয়ে পড়েছে। ঝিমিয়ে পড়া ইস্যুতে আন্দোলন চাঙা করা এখন বিরোধীদলের সামনে বড় একটি চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি সামপ্রতিক ঘটনাপ্রবাহে দলের নানা পর্যায়ে সৃষ্ট সন্দেহ-অবিশ্বাসকে দূর করারও বড় একটি বিষয়। বিএনপি নেতারা এসব নিয়ে ভাবছেন না। তাদের মতে, দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসে নীতিনির্ধারণী ফোরাম থেকেই। কার্যকর কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকে আবারও ট্র্যাকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হবে না।
এদিকে আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়নে একটি জটিলতার মধ্যে পড়েছে বিরোধী দল। রাজনীতিতে কড়া কর্মসূচি হিসেবে খ্যাত হরতালের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে তারা। দু’দফায় টানা ৫ দিন হরতাল করেছে ১৮ দলীয় জোট। এ হরতালকে কেন্দ্র করে জাতীয় জীবনে ব্যাহত হয়েছে টানা ১০টি কর্মদিবস। হরতালে বিক্ষুব্ধ কর্মীদের সঙ্গে পুলিশি সংঘর্ষে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে। কিন্তু যে ইস্যুতে আন্দোলন তার কোন হদিস করতে পারেনি সরকার। এমনকি উল্টো নৈরাজ্যের দায় চাপিয়েছে বিরোধী দলের ওপর। হরতালের সময় দ্রুত বিচার আইনে বিএনপিসহ বিরোধী জোটের প্রথম সারির ৬৪ জন নেতার বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় তারা এখন আইনি জটিলতা থেকে রেহাই পেতে ব্যস্ত। নিম্ন আদালতের দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই। এমন পরিস্থিতিতে নতুন কর্মসূচি ও আন্দোলনের কৌশল খুঁজছে বিরোধী দল। কেন্দ্রীয় নেতারা কঠোর কর্মসূচির হুমকি দিলেও বাস্তবে সমঝোতার পথ খুঁজছে দলটি। বিএনপির একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, ইলিয়াস ইস্যুকে সঙ্গে রেখে ফের তত্ত্বাবধায়কের এক দফা আন্দোলনে নামবে বিএনপি। এর অংশ হিসেবে হঠাৎ করেই ১২ই মে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় কৃষক-জনতার সমাবেশের আয়োজন করেছে স্থানীয় বিএনপি। সেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। এছাড়াও রাজবাড়ীর বাতিল হওয়া সমাবেশটি ও মুন্সীগঞ্জে চলতি মাসে আরও দু’টি সমাবেশ আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। সেখানেও খালেদা জিয়া অংশ নেবেন। বিশেষ করে তিন বন্ধু রাষ্ট্রের তিন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর শেষে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মনোভাবে এ পরিবর্তন ঘটেছে। বিএনপির সূত্র জানায়, টানা হরতালে দেশবাসীকে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। তাই নৈতিক সমর্থন দিলেও জনগণের সমস্যার কথা মাথায় রেখে আপাতত হরতালের মতো কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে চাইছেন তারা। সে সঙ্গে উচ্চ আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন জামিনের প্রেক্ষিতে নিম্ন আদালতের রায়ের বিষয়টিও পর্যবেক্ষণ করতে চায় বিরোধী দল। নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্তের পরই নতুন কর্মসূচি দেবে বিএনপি। এদিকে কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করছেন দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামের সদস্য ও জোটের নেতারা। দলীয় সূত্র জানায়, কাছাকাছি সময়ে একটি অনশন কর্মসূচি দেয়ার ব্যাপারে মতামত দিয়েছে ১৮ দলীয় জোট। তবে এখন দিনক্ষণ এবং স্থান চূড়ান্ত হয়নি। বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব নিজেও এ কর্মসূচিতে নিজের সমর্থন দিয়েছেন। এছাড়া ইলিয়াসের সন্ধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নেতাদের মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে এবং ১০ই জুন আলটিমেটামের প্রস্তুতি উপলক্ষে সারা দেশে গণসংযোগ, গণমিছিল ও গণঅবস্থান কর্মসূচি দেয়ার আলোচনা চলছে। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে গণসংযোগ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে জোটের শরিক দল জামায়াত। এ ব্যাপারে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়েনি একটা বাঁক বদল ঘটেছে। শিগগিরই কার্যকর কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলনকে ফের চাঙা করবে বিএনপি। স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, দেশের মানুষ সরকারের ওপর থেকে আস্থা তুলে নিয়েছে। বিএনপির হরতালে সেটা প্রমাণ হয়েছে। তাই জনমত বিবেচনা করে শিগগিরই নতুন কর্মসূচি দেয়া হবে।
১৪ই মে ঢাকায় গণমিছিল: নিখোঁজ ইলিয়াস আলীর সন্ধান দাবি এবং নেতাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রতিবাদে আগামী ১৪ই মে ঢাকায় গণমিছিল করবে বিএনপি। ঢাকায় গণমিছিলের আগের দিন সারা দেশের জেলা ও মহানগরীগুলোতে বিক্ষোভ করবে দলটি। গণমিছিলে অংশ নেবে ১৮ দলীয় জোটের শরিকদলগুলো। নয়া পল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সামনে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। একই দাবিতে গতকালও সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি। উল্লেখ্য, ইলিয়াসের সন্ধান দাবিতে দু’দফায় টানা ৫ দিন হরতালের পর তিন দফায় বিক্ষোভ করেছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। এদিকে নয়া পল্টনের বিক্ষোভ সমাবেশে যান হরতালে ককটেল বিস্ফোরণ ও গাড়ি পোড়ানোর মামলায় জামিন পাওয়া বেশির ভাগ নেতা। বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে দুপুরের পর থেকেই বিভিন্ন দিক থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতা-কর্মীরা জমায়েত হয় নয়া পল্টনে। বিকাল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে নেতা-কর্মীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে নয়া পল্টন। সমাবেশে বক্তব্য দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান প্রমুখ।