বার্তা৭১ ডটকমঃ
ধর্ম পালনের ভানকারীরাই সংঘাত সৃষ্টি করে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ধর্মের যথাযথ মর্যাদা রক্ষার জন্য সবাইকে আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, আসলে যারা ধর্ম পালনের নামে ধর্ম পালনের একটা ভান করে, তারাই ধর্মে ধর্মে সংঘাত সৃষ্টি করে। ধর্মের ওপর যাদের বিশ্বাস ও আস্থা আছে তারা কিন্তু কোনো অন্যায় পদক্ষেপ নিতে পারে না।
বৃহস্পতিবার বিকেলে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের শুভ বড়দিন উদযাপন এবং আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও’র কার্ডিনাল পদে উন্নীত হওয়া উপলক্ষে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রীএসব কথা বলেন। ফার্মগেটের বাংলাদেশ কৃষিবিদ মিলনায়তনে এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর পক্ষ থেকে সমগ্র খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানান। তিনি অনুষ্ঠানে বড় দিনের একটি কেক কাটেন এবং একটি স্মরণিকার মোড়কও উন্মোচন করেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, ধর্মকে যথেচ্ছভাবে ব্যবহার করলে আসলে ধর্মকেই প্রকৃতপক্ষে খাটো করা হয়, মানুষের কাছে ছোট করা হয়, হেয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দায়িত্ব যার যার ধর্মকে একটা সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। যেন কেউ কখনও কোনো ধর্ম সম্পর্কে অঙ্গুলি নির্দেশ করতে না পারে বা যেন হেয় করতে না পারে।
তিনি বলেন, ধর্মের সম্মান বজায় রাখা স্ব স্ব ধর্মের প্রত্যেকেরই দায়িত্ব এবং আমি একজন মুসলমান হিসেবে আমার ধর্ম পালন করি। তাই এই ধর্মের প্রতি আমার বিশ্বাস ও আস্থা আছে। অন্যরাও যেন বাংলাদেশে তার ধর্মটা যথাযথভাবে পালন করতে পারে সেই পরিবেশ বজায় রাখতে চাই।
অনুষ্ঠানে আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও, ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বক্তৃতা করেন। ফ্রান্সিস সরোদ গোমেজ অনুষ্ঠানে সভাপতিত্বে করেন এবং বাংলাদেশ খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনার জানেন যে- বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে জাতির পিতা আত্মনিয়োগ করেছিলেন। অত্যন্ত দুঃখের বিষয় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। আমি ও আমার বোন রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যাই। কিন্তু স্বজন হারানোর ব্যথাটা আমি বুঝি। আমরা আমাদের বাবা-মা-ভাই আপনজন হারিয়েছিলাম। কিন্তুু বাংলাদেশ কি হারিয়েছিল? বাংলাদেশতো তার সকল সম্ভাবনা হারিয়েছিল ।
শেখ হাসিনা বলেন, সেই সময়ে (বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে) এই বাংলাদেশ যেখানে একটা সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। সব ধর্মের মানুষের জন্য একটা শান্তিপূর্ণ বসবাসের জায়গা হয়েছিল। সেখানে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিয়ে একটি সংঘাত লাগানোর চেষ্টা সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর থেকেই শুরু হয়েছিল, এটাই হচ্ছে দুর্ভাগ্যজনক।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, সেই চেতনায় বাংলাদেশ আবার জেগে উঠেছে। আমাদের দেশের সঠিক ইতিহাস এদেশের মানুষ জানতে পারছে এবং আজকে যেন আত্মবিশ্বাসটা নিয়ে দেশ আবার এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিলেন যে একটা সময়ে হঠাৎ একজন খ্রিস্টানকে, একজন বুদ্ধিষ্ট, একজন হিন্দু এমনকি মুসলমান কোরআন শরিফ পড়ছে মসজিদে বসে তাকেও হত্যা করা হলো এবং শুরু হলো ব্যাপক প্রচার। অর্থাৎ বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করার জন্যই যেন এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে শুরু করলো। মানুষকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হলো। কোনো মানুষ জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারতে পারে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য, এটা আসলে বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু আমরা সেই বিভৎস ভয়াবহ অবস্থাও দেখেছি এই বাংলাদেশে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালের সেই জানুয়ারি থেকে মার্চ মাসের কথা একটু চিন্তা করে দেখেন। কী জঘন্য ঘটনা এই বাংলাদেশে বিএনপি-জামায়াত জোট ঘটিয়েছিল। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে আর বলা হচ্ছে ওটাই নাকি আন্দোলন। সেই আন্দোলন করে নাকি আবার সরকার উৎখাত করবে। ভোট দিয়ে জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে। জনগণ ক্ষমতা দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, খ্রিস্টান ধর্মের প্রবক্তা যিশুখ্রীষ্ট সবসময় আর্ত-পীড়িতকে সাহায্য করতেন, তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। আমরা যদি সব ধর্মের মর্মবাণীর দিকে তাকাই তাহলে কিন্তুু সাদৃশ্য দেখতে পাব। প্রত্যেক ধর্মেই কিন্তু শান্তির কথা বলা হয়েছে। সহশীলতার ও মানবতার কথা বলা হয়েছে। অনাহার ক্লিষ্ট, রোগাক্রান্ত অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। কাজেই আমরা এই বাংলাদেশে সবসময় এটাই বিশ্বাস করি- এখানে সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকবে। এটাই হচ্ছে আমাদের মূল নীতি। আমাদের সংবিধানেই এই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কার্ডিনাল মনোনীত হওয়া আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজরিওকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বিশ্বে খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস আর্চ বিশপ প্যাট্রিক ডি রোজারিও সিএসসিকে কার্ডিনাল পদে উন্নীত করেছেন। এই প্রথম আমরা এই পদে একজন বাঙালিকে পেলাম। যেটা আমরা আগে কখনও চিন্তাও করতে পারিনি। সারাবিশ্বে মাত্র ১২১ জন কার্ডিনাল যারা পোপ হিসেবে প্রার্থী হতে পারবেন আবার পোপ নির্বাচনের জন্য ভোট দিতে পারবেন। সেই ভোটদানের অধিকারটা আজকে একজন বাঙালি পেয়েছেন। কাজেই আজকে আমরা খুবই আনন্দিত এই আনন্দটা শুধু খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের নয়, সমগ্র বাঙালি জাতির। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আজকে সকলেই আনন্দিত বলে আমি মনে করি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে আমরা একটি উন্নত দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই। যেটা জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল। একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা এই সোনার বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য যে বাণী আমাদের দিয়েছেন এবং আমাদের সংবিধানেও স্পষ্ট উল্লেখ আছে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়, অনেকেই এর ভুল ব্যাখ্যা করে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতায় নিয়ে আসে। আর আমরাওতো ধর্মহীনতায় বিশ্বাস করি না। যার যার ধর্ম সে সে পূর্ণ অধিকার নিয়ে পরিপূর্ণভাবে পালন করতে পারবে। সেই পরিপূর্ণভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারাটাই ধর্ম নিরপেক্ষতা। ধর্মকে বাদ দিয়ে নয়।