বার্তা৭১ ডটকমঃ অর্থনীতির স্বাভাবিক গতি ধরে রাখতে চলতি অর্থবছরে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ প্রয়োজন পাঁচ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। অথচ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে কাগজে-কলমে বিনিয়োগ নিবন্ধিত হয়েছে মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকা। নিবন্ধনের এ পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ হাজার কোটি টাকা কম। যদিও বিনিয়োগের বাস্তব চিত্র আরো মারাত্মক বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিনিয়োগে এমন খরার কারণে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বেড়ে চলেছে বেকারত্বের হার এবং বাড়ছে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ। বিনিয়োগের এমন মন্দাবস্থার জন্য রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পাশাপাশি নিম্ন মানের সরকারি বিনিয়োগকে দায়ী করছেন বিশ্লেষকেরা।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থনীতির সাধারণ সূত্র অনুযায়ী সরকারি বিনিয়োগ বাড়লে বেসরকারি বিনিয়োগও বাড়ে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সূত্র কাজে আসছে না। এর কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও এ ক্ষেত্রে অদক্ষতা রয়েছে। বিনিয়োগের বড় অংশ চলে যাচ্ছে দুর্নীতিবাজদের পকেটে।
তাদের মতে, প্রতি বছরই অর্থবছরের নয় বা দশ মাস শেষ হওয়ার পরও এডিপি বাস্তবায়নের হার খুবই কম থাকে। শেষ দুই মাসে তাড়াহুড়া করে অর্থ খরচ করা হয়। উন্নয়নের নামে টাকা ভাগাভাগি হয়, নিম্ন মানের কাজ করে তুলে নেয়া হয় অর্থ। এভাবে যেনতেন উপায়ে সরকারি ব্যয় বাড়ানো হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা কম বলে মন্তব্য বিশ্লেষকদের।
‘আন্তর্জাতিক ঋণ পরিসংখ্যান ২০১৮’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমার মূল কারণ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা। এ ছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ পিছিয়ে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না বিনিয়োগকারীরা। প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালে যেখানে বিনিয়োগ ছিল ২৪৩ কোটি ৭২ লাখ ডলার, ২০১৬ সালে তা কমে হয়েছে ১৭০ কোটি ৬৪ লাখ ডলার। এক বছরের ব্যবধানে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) কমেছে ৭৩ কোটি ৮ লাখ মার্কিন ডলার (৫ হাজার ৯০৪ কোটি টাকা)।
‘সাউথ এশিয়া ফোকাস’ শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের অন্য এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ ঝুঁকি তিনটি। এগুলো হচ্ছে- আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার আরো অবনতি, রাজস্ব খাতের সংস্কারের অভাব ও আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা।
দেশের মোট বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ বেসরকারি খাত থেকে আসে জানিয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, দেশের বর্তমান পরিবেশ বিনিয়োগকারীদের অনুকূলে নয়। এ কারণে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ ক্রমেই কমে যাচ্ছে।
আগামীতে সমস্যা আরো বাড়বে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য নিয়মিত কিছু সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস-বিদ্যুৎ ছাড়াও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং ঋণের উচ্চ সুদের হার উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে এখনই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, কেবল মুখে না বলে দ্রুত ওয়ানস্টপ বিনিয়োগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
উদ্যোক্তাদের অভিযোগ, প্রচারণার ক্ষেত্রে সরকার যাই বলুক না কেন বাস্তবে দেশে শিল্প ও বিনিয়োগবান্ধব কার্যকর কোরো নীতি নেই। সরকার নিজেই আছে একটি অনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে নীতি নিয়ে সরকার এগোচ্ছে সেখানেই লুকিয়ে আছে শিল্প বিকাশের অন্তরায়। কেননা সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কোনো সার্ভিস পাওয়া যায় না। জমি কিনে একটি প্রকল্প পাস করাতে সরকারের বিভিন্ন দফতরে ঘাটে ঘাটে মাসের পর মাস ধরনা দিতে হয়।
সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘুষখোর-দুর্নীতিবাজদের ছড়াছড়ি। ঘুষ না দিলে দফায় দফায় নানা প্রশ্ন আর অজুহাত খাড়া করে হেনস্তা করা হয়। এর মধ্যে ব্যাংকঋণের সুদ টানতে গিয়ে উদ্যোক্তার নাভিশ্বাস অবস্থা দেখা দেয়। অথচ আমাদের পাশের দেশ ভারত ছাড়াও সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, চীনসহ অন্যান্য দেশে কেউ বিনিয়োগ করতে চাইলে অতি দ্রুততার সাথে সব কিছু এক ছাতার নিচে সম্পন্ন করা সম্ভব।
বেসরকারি খাতে কম বিনিয়োগই বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল সমস্যা জানিয়ে বিশ্বব্যাংকের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের জন্য দেশে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসায় শুরু করার ক্ষেত্রে যেসব আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছিল তা এখনো বহাল আছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে এখনো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। চাহিদার সাথে সরবরাহের ঘাটতি তো আছেই। তার মতে, ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগে অন্যতম সমস্যা হলো ভূমি সঙ্কট। তিনি বলেন, সঙ্কট নিরসনে শক্তিশালী সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন মূল্যায়ন ও পরিবীক্ষণ বিভাগ (আইএমইডি) প্রতিনিয়তই বলছে, সরকারের বিনিয়োগ বাড়ানো হলেও এ সব বিনিয়োগের অবকাঠামো নিম্ন মানের হচ্ছে। ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে সরকারি বিনিয়োগের প্রভাব পড়ছে না। প্রায় আট বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২ শতাংশের আশপাশে অবস্থান করছে। চলতি অর্থবছরে তা বেড়ে ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ হওয়ার প্রত্যাশা করছে সরকার। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, অনেক সময় সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পর অবকাঠামো তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগে।
ফলে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়তে দেরি হতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে সেটিও হচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ সময় পরও কাক্সিক্ষত অবকাঠামো নির্মাণ হয় না। তা ছাড়া যেসব অবকাঠামো তৈরি হয়, তাতে অপচয়ের কারণে খরচ অনেক বেশি হয়। ফলে সরকার যতটা ব্যয় করছে সে অনুযায়ী অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। প্রতি বছর পড়া লেখা শেষ করে ২৪ থেকে ২৫ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। যারা কোনো চাকরি পায় না। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৭ কোটির বেশি। তন্মধ্যে ১০ কোটি আছে কর্মক্ষম মানুষ। পাঁচ কোটি মানুষ কাজ করছে। পাঁচ কোটি মানুষ কোনোভাবেই কাজ পায় না।
বিবিএসের হিসাব মতে, ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিক কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ছয় কোটি সাত লাখ। এর মধ্যে পাঁচ কোটি ৮০ লাখ বিভিন্ন পেশায় ও উৎপাদনশীল কাজে নিয়োজিত। অবশিষ্ট ২৭ লাখ পুরোপুরি বেকার। একই প্রতিবেদনে অবশ্য বলা হয়েছে- পরিবারের মধ্যে কাজ করেন কিন্তু কোনো ধরনের মজুরি দেয়া হয় না অথবা পান না।
এ ধরনের বেকারের সংখ্যা এক কোটি ১১ লাখ। এক কোটি ছয় লাখ লোক আছেন যাদের কাজের কোনো ঠিকঠিকানা বা নিশ্চয়তা নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) মতামত অনুযায়ী প্রকৃত অর্থে এরাও বেকার। অর্থাৎ সরকারি হিসেবেই বেকারের প্রকৃত সংখ্যা হবে দুই কোটি ৪৪ লাখ। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হওয়ায় বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
সরকারের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা না হলে বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা নেই মন্তব্য করে রফতানিকারকদের ৪২টি সংগঠনের সমন্বয়ে গড়া সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি এবং বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী নয়া দিগন্তকে বলেন, বিনিয়োগের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুতের নিশ্চয়তা থাকা দরকার।
আমাদের এখানে দুটোরই সঙ্কট রয়েছে। শিল্পে ঠিকভাবে গ্যাস ও বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তার ওপর দফায় দফায় দাম বাড়ানো হচ্ছে। জ্বালানির সরবরাহ ও দামে এতটা অস্থিরতা থাকলে ব্যবসায়ের পরিকল্পনা করা কঠিন। এভাবে চলতে থাকলে বেকারত্বের হার আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।