বার্তা৭১ ডটকমঃ বাংলার বর্ষ পরিক্রমায় আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে ১৫ আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে রক্ত পিপাসায় উন্মত্ত কতিপয় দুষ্কৃতকারী বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুনের মাধ্যমে ইতিহাসের নৃশংসতম এক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল; এত খুন, এত রক্তপাত, এত লাশ, পৃথিবীর ইতিহাসে নারকীয়তার এমন নজির আর আছে কিনা, জানা নেই আমার; ঘটনার আকস্মিকতা ও বীভৎসতায় বিদীর্ণ হৃদয় জনগণ স্তম্ভিত, হতবাক হয়ে পড়েছিল; ভীত কম্পিত শিশু রাসেল বাড়ির লোকদের বুকে মুখ লুকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলেছিল- ‘ওরা কি আমাকেও মেরে ফেলবে?’ বাড়ির স্বজনদের মিথ্যে আশ্বাস ছিল- ‘না না, তোমার কিছু হবে না।’ পরক্ষণেই ন্যূনতম মনুষ্যত্বহীন ঘাতকের আগ্রাসী গুলিতে নিরপরাধ রাসেলের প্রাণহীন কচি দেহ লুটিয়ে পড়েছিল মাটিতে। সেই অন্তিম মুহূর্তে ঘাতকদের শিশু সন্তানরা কি কেঁদে উঠেছিল নিহত রাসেলের এমন অপমৃত্যু দেখে? কী আক্রোশে তারা এমন উন্মত্ত হয়েছিল যে নিষ্পাপ-নির্দোষ শিশু হত্যায় একবারও কেঁপে ওঠেনি তাদের হাত? মনুষ্যত্ব, মানবতাবোধ, মানসিক ভারসাম্য সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত না হলে এমন আসুরিক উন্মাদনা এবং এরূপ গণহত্যা, নারী ও শিশু নিধন শয়তানের বিকৃত কল্পনাতেও সম্ভব কি না তা আজ ভাবতে হবে।
রাসেলের মৃত্যু এখনও আমাকে নিয়ে যায় অদ্ভুত অপরাধবোধের অমানিশায়; আবার ফিরে আসি অবোধ শিশুর সকরুণ গোঙানির কাছে; এই যে এত জল বয়ে যায়, গঙ্গোত্রী থেকে পদ্মা হয়ে বঙ্গোপসাগরে, সেই স্রোতধারা কি পেরেছে আকাশদীর্ঘ কালিমাকে মুছে দিতে? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আজও কি সেই অশনি পিশাচের করাল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত? স্বাধীনতার বিয়াল্লিশ বছর পরেও কি আমাদের রাসেলরা লাল-সবুজের অভয়ারণ্যে মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়াতে পারছে? যদি দৃষ্টির মহাকাশ খোলা থাকে, যদি বীক্ষণের দিগন্ত থাকে উন্মীলিত, তবে দেখতে পাবো নররূপী শ্বাপদের বীভৎস উল্লাস কালো মেঘ হয়ে যেন শাসিয়ে রাখতে চায় বাংলাদেশ ও নিষ্কলঙ্ক রাসেলদের।
জুডাস তার প্রভু যিশুখ্রিস্টের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল; ব্রুটাস হত্যা করেছিল তার পরম হিতৈষী জুলিয়াস সিজারকে; জন উইলকিন বুথ কেড়ে নিয়েছিল আব্রাহাম লিঙ্কনের প্রাণ; লি হার্ভে অসওয়াল্ড গুলি করে হত্যা করেছিল জন এফ কেনেডিকে; গোঁড়া হিন্দু নাথুরাম গডসে খুন করেছিল মহাত্মা গান্ধীকে; মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর কারণ হয়েছিল; কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীরা বহু হত্যার জন্য দায়ী। শৈশবেই জীবনের অনন্ত তৃষা থেকে বিদায় নিতে চায়নি যে উৎসুক শিশু, তার দুটি কচি হাত এবং সদ্য বিবাহিত দুই নববধূর মেহেদী রাঙানো চারটি হাত বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত হয়ে যেন আদিগন্ত প্রসারিত হতে হতে জানতে চেয়েছিল- আমাদের কেন? কী আমাদের অপরাধ? অপরাধ না থাকলেও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হায়েনারা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল, রক্তাক্ত করেছিল শুধু ধানম-ি বত্রিশ নম্বরের বাড়িটিকেই নয়, সারা বাংলাদেশের মাটিকেও।
ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক কুলদীপ নায়ার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেছিলেন- ‘এই মানুষটির রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল এমন একজন পরিপক্ব রাজনীতিবিদ ও আইনজ্ঞের কাছে, যিনি উপমহাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক যুগের অধিক সময় ধরে ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা, আদর্শ, নীতি ও আচার-ব্যবহারের প্রভাব বঙ্গবন্ধুর ওপর পড়েছে ব্যাপকভাবেই এবং পরিশেষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে একজন মহান রাজনীতিবিদ হতে;’ তিনি আরও বলেছেন- ‘শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় ও অমোঘ ব্যক্তিত্ব তাঁকে শুধু বাংলারই একজন শ্রেষ্ঠ নেতা রূপেই আবির্ভূত হতে সাহায্য করেছে তা নয়- তাঁর মহান মানবতাবোধ, বিশাল অন্তকরণ তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতেও ভূষিত করেছে।’ কুলদীপ নায়ার আরও জানান- ‘বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও আদর্শে প্রভাব সৃষ্টিকারী সেই ব্যক্তিটি হলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।’ তাঁকে তিনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক গুরু বলে উল্লেখ করেন। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধু নিজেকে বিশ্বের একজন সেরা রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। আর তাঁর ব্যক্তিগত গুণের মহিমায় তিনি বাংলার আপামর জনসাধারণের নয়নমণি ও বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেছিলেন। কুলদীপ নায়ার তাঁর ‘ডিসট্যান্ট নেইবার’ বইতে এসব তথ্য তুলে ধরেছেন।
আমেরিকার বিখ্যাত সাময়িকী নিউজউইকের প্রথিতযশা সাংবাদিক লরেন্স জেকিংস বঙ্গবন্ধুকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ তথা রাজনীতির কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তার একটি প্রতিবেদনে। তিনি বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক ও উপযুক্ত নেতা রূপে আখ্যায়িত করেছেন। যেসব গুণে গুণান্বিত হলে একজন মানুষ জাতীয় নেতা রূপে আবির্ভূত হতে পারেন, তার সবটুকুই বিদ্যমান ছিল বঙ্গবন্ধুর মাঝে। নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও বঙ্গবন্ধুকে তিনি কখনও বিচলিত হতে দেখেননি। চরম বিপদেও তাঁকে হাসতে দেখেছেন। লরেন্স আরও বলেছেন- ‘আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, জাতির সামনে এক আসন্ন দুর্যোগ আর আপনার জন্য করুণ পরিণতি সামনে অপেক্ষা করছে, তবু এ অবস্থায় আপনি হাসছেন? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘এমনকি আমি নরকেও হাসতে পারি।’ বঙ্গবন্ধুর এই উক্তিতে লরেন্স বিস্মিত হয়েছিলেন তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তা, অসমসাহসিকতা ও আত্মবিশ্বাসের কাঠিন্য দেখে।
নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ম্যালকম এম ব্রাউন বঙ্গবন্ধুকে ফ্রান্সের এডমন্ড বার্কের চেয়েও উচ্চ স্থানে বসিয়েছেন। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলি হেলনে সারাদেশ উঠত আর বসত। বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কারো তর্জনী এত কার্যকর হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে তিনি পৃথিবীর একজন সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন- ‘বঙ্গবন্ধুর আবির্ভাব শুধু বাঙালী জাতির জন্য নয়, বরং সারা উপমহাদেশের জন্যই ছিল আশীর্বাদস্বরূপ।’
এই উপমহাদেশে একজন প্রখ্যাত বিপ্লবী নেতা, মানবতাবাদী চিন্তাবিদ মানবেন্দ্রনাথ রায় বিপ্লবীর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘দরিদ্র বা নিপীড়িত হলেই মানুষ বিপ্লবী হয় না; একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত বিপ্লবী বা বিপ্লবের নেতা তখনই বলা যায় যখন তিনি নিজের স্বার্থকে দেশের জনগণের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সম্পূর্ণভাবে এক করে নিতে সক্ষম হন, জনগণের সঙ্গে এক হয়ে যান। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী আমাদের সময়কালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে একজন পরিপূর্ণ বিপ্লবী নেতা হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারি; বিপ্লবের গতানুগতিকতার বাইরে তিনি ছিলেন আশ্চর্য ব্যতিক্রমী বিপ্লবী; ব্যতিক্রমী এই কারণে যে, আমরা সাধারণত যে সকল বিপ্লবীর কথা জানি তাঁদের অনেকেই ছিলেন তাত্ত্বিক বিপ্লবী। তাঁরা কোন বিপ্লবী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে জনগণের ওপর সেই আদর্শকে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন, যে কারণে অনেকেই জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন আবার অনেকে কৌশলগত কারণে কোন অর্ধশিক্ষিত ধর্মীয় নেতার ওপর ভর করে সহজে জনপ্রিয় হওয়ার চেষ্টা করেছেন। জনগণের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দিতে দ্বিধা করেননি; কিন্তু বঙ্গবন্ধু জনগণের অভীষ্ট লক্ষ্য যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন; তাদের মূল সমস্যা চিহ্নিত করে সেগুলো নিরসনের পথ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করে তাদের চিন্তা-চেতনায় আনতে পেরেছিলেন বৈপ্লবিক পরিবর্তন।
বিশ্ব রাজনীতিতে কিছু রাজনীতিবিদ আছেন যাঁরা নিজ নিজ দেশের সীমানা পেরিয়ে ভিন দেশের জনগণের কাছেও পৌঁছে গেছেন; তাঁরা হয়ে উঠেছেন সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক, সারা পৃথিবীর দিশারী। মহাত্মা গান্ধী, কেনেডি, মাও সে তুং, লেনিন, ড. সুকর্ণ, কামাল আতাতুর্ক, জামাল আব্দেল নাসের প্রমুখ তাঁদের অন্তর্ভুক্ত। প্রকৃতপক্ষে তাঁদের রাজনৈতিক জীবন ছিল অনেক দীর্ঘ; আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁদের পরিচিত হওয়ার সুযোগ ছিল অনেক বেশি। তাঁদের সঙ্গে তুলনা করলে শেখ মুজিব বিশ্বরাজনীতিতে পরিচিত হতে শুরু করেছিলেন পাকিস্তানের প্রথম স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় হতে। সে সময় পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের খুব আস্থাভাজন মিত্র ছিল; সেই পাকিস্তানের গণবিরোধী রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে পরিচালিত গণআন্দোলনের নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন সেই সময়কার আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান।
ভারতের কেরলের আদি নিবাসী ড. সিরিজা কে. মাপ্রিয়াল দীর্ঘকাল বঙ্গবন্ধুর ওপর পড়াশোনা ও গবেষণা করে বলেছিলেন- ‘ভারতীয় হিসেবে আমরা গর্বিত যে, আমাদের দেশে মহাত্মা গান্ধী জন্মগ্রহণ করেছেন। বাঙালী জাতির গর্ব করা উচিত যে, বাংলাদেশে শেখ মুজিবের মতো এক মহান নেতার জন্ম হয়েছিল; মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর তফাৎ, তিনি বাংলাদেশকে দুই বার স্বাধীন করেছিলেন। একবার ১৯৭১ সালে, আর একবার ১৯৭২ সালে যখন তাঁর অনুরোধে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সৈন্যরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায়। উল্লেখ্য, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও মার্কিন সেনারা কয়েক যুগ অবস্থান করেছে জাপান ও ইউরোপের মাটিতে; ভারতে যেমন মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করা হয়েছে, বাংলাদেশেও ঠিক তেমন করে জাতির জনককে বিনাশ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শুধু বাঙালীর গৌরব নন, গোটা বিশ্বের আপামর জনগোষ্ঠীর গর্ব। তিনি সারা বিশ্বে শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও হতভাগ্য মানুষের মুক্তির প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। দুর্ভাগ্য বাঙালীর, দুর্ভাগ্য তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশের জনগণের, হঠাৎ করেই এমন জাজ্ব¡ল্যমান নক্ষত্রকে আমাদের ভাগ্যাকাশ থেকে সরিয়ে দেয়া হলো। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সমার্থক। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে যে কোন সময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গভীর আলোচনা অনস্বীকার্য। যদি সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থার ওপর আলোকপাত করি, প্রশ্ন জাগে। কোন্ দিকে যাচ্ছে তবে বাংলাদেশ? সুশাসনের পালে কবে মৌসুমী হাওয়া লাগবে? জাতির জনকের চিরকাক্সিক্ষত সোনার বাংলার বুকে আজ আবার হিংস্র হায়েনার দল বসাতে চাইছে ভয়ঙ্কর থাবা। আমাদের লালিত আশা ও স্বপ্ন অজান্তেই নিমজ্জিত হচ্ছে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধত্ব, প্রতিক্রিয়াশীলতা ও ধর্মীয় গোঁড়ামি নামক চেনা চোরাবালিতে। একদিকে আপামর বাঙালীর প্রাণের ইচ্ছা ও আকাক্সক্ষার প্রতিফলন যেমন দেখতে পাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার গতিশীলতা ও ত্বরান্বয়নকে কেন্দ্র করে, ঠিক তখনই সেই প্রয়াসকে সমূলে নস্যাত করে দিতে দেশজুড়ে জামায়াত শিবিরের অকল্পনীয় তা-ব, হিংসাশ্রয়ী হানাহানি, বোমাবাজি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর অকথ্য নির্যাতন, সংখ্যাস্বল্প সম্প্রদায়ের মানুষদের ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা, ধর্ষণ-রাহাজানি-খুনসহ আরও নানা অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে জাতীয় রাজনীতিতে বিপর্যয় নিয়ে আসা হয়। এই স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি চূড়ান্ত হিংসা ও মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ আজ। তার সঙ্গে ধর্মব্যবসাকে আরও একবার অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে উদ্যত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। হেফাজতে ইসলাম আসলে জামায়াতের হীনস্বার্থ চরিতার্থকরণ প্রকল্পের একটি অস্ত্র, তাদের আজ্ঞাবহ মুখপাত্র, কেবল ভিন্ন নামে একই উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে রাজপথে নেমেছে এই অতিপ্রতিক্রিয়াশীল চক্র। ইসলামকে রক্ষার নামে শান্তিময় ইসলামকে অপবিত্রকরণের এক অবিশ্বাস্য প্রয়াসে মেতে উঠেছে এই ভ-ের দল। এদের নেতৃত্বে আছে এমন একজন যিনি একাধারে তীব্র সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী, ভয়াবহ নারী বিদ্বেষী, পশ্চাদমুখী এবং পবিত্র ইসলামের ভুল ব্যাখ্যাকারী। অপরিণামদর্শী ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভীক্ষায় সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিপক্ষের এই জামায়াত চক্রের অপতৎপরতাকে সাহায্য করে চলেছে গোপন কোন অভীপ্সায়। পাঁচ মে ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এরা বিপুল সংখ্যক অনুগামীদের নিয়ে বর্তমান সরকারকে উৎখাত করার অসাংবিধানিক উদ্দেশ্যে বিএনপি-জামায়াত চক্রের সঙ্গে লিপ্ত হয়েছিল গভীর ষড়যন্ত্রে। মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে শুরু করে ভয়াবহ জিঘাংসা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, অসংখ্য কোরান শরীফ পুড়িয়ে ফেলার মতো পৈশাচিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে তারা। মাদ্রাসাপড়ুয়া অগণিত কিশোরকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে এসেছিল সেদিন।
তবে কি আমাদের জন্য আশার কোন বার্তা নেই? যে চিরসবুজ প্রেরণায় বিভোর হয়ে লাখো শহীদের রক্তে স্বাধীন হয়েছে আমাদের মাতৃভূমি, কোন অশুভ শক্তির হাতে তার অপার সম্ভাবনা ভূলুণ্ঠিত হতে পারে না; গ্লানিভরা কোন ম্লানিমা স্পর্শ করতে পারে না তাকে; অনেক অসঙ্গতি, অব্যবস্থাপনা, অসফলতার পরেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে ক্রমশ, ধীরে ধীরে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিচ্ছে জগৎসভায়। আমরা দেখতে পাই, শেষ পর্যন্ত যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া চলমান; ক্ষমতার দম্ভে প্রচ- উদ্ধত-অসংযত সাকা চৌধুরীসহ আরও ছয়জনের ফাঁসির রায় দিয়েছেন অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সারা বাংলাদেশ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলেছে। আবার মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের বর্তমান সূচকে সবচেয়ে ভাল অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন, কৃষি, শিক্ষা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানি, বিদ্যুতসহ আরও অনেক ক্ষেত্রে যখন উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, নতুনভাবে পরিচিতি পাচ্ছে বিশ্বদরবারে, তখন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির আস্ফালন আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তবু বিশ্বাস করি, এই প্রখর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ দুঃসময়েও আমরা এগিয়ে যাব, এগিয়ে যাবে স্বাধীনতার চেতনা, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, প্রকৃত শিক্ষায় দীক্ষিত, দেশীয় মূল্যবোধে উজ্জীবিত আমাদের তরুণ প্রজন্ম; হাজার সমস্যার ভেতরেও আগামী বাংলাদেশের কা-ারী হবে সীমাহীন সম্ভাবনাময় এই তরুণেরা। এরা সূর্যশক্তিতে বলীয়ান হয়ে লড়াই করবে সমস্ত অন্যায়, দুর্নীতি, মৌলবাদ, অর্থনৈতিক ভেদাভেদ, সামাজিক অনাচার ও ভ-ামির বিরুদ্ধে; সব বাধাকে উপেক্ষা করে এরা এগিয়ে যাবে সত্যিকারের প্রগতিশীলতার দিকে। জাতির জনকের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই আমরা এগিয়ে যাব নতুন সকালের অরুণ প্রপাতের দিকে। আজ অদ্ভুত কুহেলিকার জতুগৃহে আটকা পড়েছে স্বদেশ। ১৫ আগস্ট সমগ্র বাঙালী জাতির জন্য এক নৃশংসতম দিন। বাঙালী হারিয়েছে তাঁর শ্রেষ্ঠতম সন্তান শেখ মুজিবকে; অথচ এই ১৫ আগস্ট নিয়ে চলছে রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত জঘন্য সংস্কৃতি; একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতা এই দিনে তার জন্মদিন পালন করেন, যা প্রকৃতপক্ষে তার জন্মতারিখ নয়। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। ১৫ আগস্ট শুধু এক মহান নক্ষত্রের ঝড়ে পড়ার দিন নয়Ñ এটি আসলে আরও দীর্ঘ, আরও ব্যাপ্ত; মননের মহাজগৎ উন্মুক্ত করে দিয়ে নিভৃতে বোধে শাণ দেয়ার দিন, নিজের ভেতর নিজস্ব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গহন চিন্তা খোঁড়ার দিন আর গভীরভাবে বুঝতে শেখা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আসল গতি, প্রকৃতি, আলেখ্য, শত্রু-মিত্র, আত্মপরিচয় ও বহুমাত্রিক বিভিন্নতা।
বাংলাদেশ আজ যখন যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য ও শ্রদ্ধার সঙ্গে জাতীয় শোক দিবস পালন করতে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে নিকৃষ্ট কালনাগিনীরা আবারও বাংলার বাতাসে বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলছে। সারা বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক জনসাধারণ যখন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে সোচ্চার, তখন স্বাধীনতার শত্রুরা আবারও বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন নামে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তারা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর ২১ আগস্ট তারিখে গ্রেনেড হামলার মধ্য দিয়ে আরেকটি ১৫ আগস্ট সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছিল। তারা প্রকাশ্যে হুমকি দিচ্ছে শেখ হাসিনাকেও নাকি ১৫ আগস্টের মতো পরিণতি ভোগ করতে হবে। তাই এখন সময় এসেছে স্বাধীনতাবিরোধী এই সকল কুচক্রীকে সামাজিক ও রাজনৈতিকাভাবে প্রতিহত করার। গণতন্ত্র, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাসী সমস্ত বাঙালীকে আজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে যাতে করে বাঙালী আগামী দিনে যথাযোগ্য অর্জন, অবদান ও উজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে জাতি হিসেবে মাথা উঁঁচু করে বিশ্বদরবারে গৌরব ও সম্মানের সঙ্গে টিকে থাকতে পারে।