শিশু-কিশোরদের জন্য পঠন-পাঠন পুরো বিষয়টিকেই আনন্দময় করতে চান বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। তিনি বলেন, ভীষণ রকমের পরীক্ষার চাপ ও মুখস্থ করার প্রবণতা যেনো না থাকে। শিশুরা নিজেরাই অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শিখবে। একটি আনন্দময় পরিবেশে তারা শিক্ষা নেবে, যা তারা নিজের জীবনে কাজে লাগাতে পারবে।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) এক কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য সবার ক্ষেত্রে সুযোগ সৃষ্টি করা। বৈশ্বিক যে আকাঙ্ক্ষা আছে, তা যেনো পূরণ হয় সেই লক্ষ্য আমাদের রয়েছে। প্রথমে হয়তো কিছু কিছু ভুলভ্রান্তি হতে পারে। তবে পাইলটিং শেষ করার আগে সেগুলো সংশোধন সম্ভব হবে।
কর্মশালায় ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, শিক্ষার্থীদের বয়সভিত্তিক দক্ষতা অর্জনে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আমাদের অর্থনৈতিক চাহিদা পূরণে দক্ষতাভিত্তিক মানবসম্পদ তৈরি করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কমলেও আমাদের দেশে ফলভিত্তিক মেধার প্রতি বিশেষ ঝোঁক আছে। এ কারণে আমরা শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তন করার চেষ্টা করছি।
তিনি বলেন, শুধু কারিকুলাম পরিবর্তন করলে হবে না, তা বাস্তবায়নের সক্ষমতাও তৈরি করতে হবে। নতুন কারিকুলামে গ্রামের শিশুদের সঙ্গে শহরের শিশুদের বৈষম্য না থাকে সেদিকে নজর দেয়া হয়েছে।
কর্মশালায় উপস্থিত থেকে শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, শুধুমাত্র পড়ালেখার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আনন্দ বলে কিছু নেই। সেজন্য শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন আনন্দময় করতে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের কাজ নেয়া হয়েছে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা শুধু মেধা নয়, নিজেরা নিজেদের মতো করে তথ্য বিশ্লেষণ করতে পারবে।
তিনি বলেন, নতুন কারিকুলাম প্রণয়নের আগে পাইলট প্রোগ্রাম হবে, বাচ্চাদের পড়ানো হবে, তারা কোনটা নিতে পারে, কোনটা নিতে পারে না, তা দেখা হবে। সে অনুযায়ী প্রয়োজনে সংশোধন করা হবে। তারপর বই দেয়া হবে।
মানুষের মস্তিষ্ক মুখস্থ করার জন্য নয় জানিয়ে জাফর ইকবাল বলেন, মস্তিষ্ক হচ্ছে তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য, সমস্যা সমাধানের জন্য। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন হলে তথ্য মাথায় নিয়ে শিক্ষার্থীরা আর ঘুরবে না, তারা সেটি বিশ্লেষণ করতে সক্ষম হবে। নতুন পদ্ধতির কারণে কোচিং করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।
শিক্ষাবিদ ড. সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, শুধুমাত্র মুখস্থ করে চাকরির বাজারে ঢোকাই শিক্ষার কাজ নয়। ভাষাজ্ঞানও আমাদের জানা দরকার। আমরা বহুদিন ধরে খণ্ডে খণ্ডে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দিচ্ছি। প্রাইমারি শেষ করে ক্লাস সিক্সে শিক্ষার্থীরা যেনো আরেকটি সমুদ্রের মধ্যে পড়ে। জোর করে তাদের ওপর বিভিন্ন বিষয় চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। সেজন্য আশা করছি, শিক্ষার্থীদের মুখস্তবিদ্যা থেকে বেরিয়ে আসতে নতুন কারিকুলাম বড় ভূমিকা রাখবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবুল মোমেন বলেন, আজকের দিনে সর্বত্র বলা হচ্ছে, শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে সবচেয়ে সেরা বিনিয়োগ। কিন্তু জিডিপি বা বাজেটের দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষায় আমরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় নেই। পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকেও আমরা পিছিয়ে আছি। সেজন্য শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এনসিটিবি চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের যেসব স্কুলে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করা হবে, এরকম ১১৫ টি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এনসিটিবির আওতায় সব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। কীভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে সেটার একটা স্কিমও প্রস্তুত আছে। এজন্য কিছু শিক্ষককে মাস্টার ট্রেইনার হিসেবে তৈরি করা হবে। তারা অন্যদের প্রশিক্ষণ দেবেন। কিন্তু ২০২৩ সালের মধ্যে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ শেষ না হলে এনসিটিবি নতুন শিক্ষাক্রমের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করবে না।
শিক্ষাক্রমে শিক্ষাবিদদের চেয়ে এনজিওর প্রভাব বেশি- এমন সমালোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা মিথ্যাচার ও ভিত্তিহীন কথা। আমাদের এ পাঠ্যক্রম প্রস্তুতে কোনো এনজিও জড়িত ছিলো না।
এনসিটিবি চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) অধ্যাপক মশিউজ্জামানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় আরো বক্তব্য রাখেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন, ঢাবির রোবটিক্স অ্যান্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. লাফিফা জামাল, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. এম তারিক আহসান, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (সরকারি মাধ্যমিক) ডা. সৈয়দ ইমামুল হোসেন, এনসিটিবি সদস্য অধ্যাপক মো. ফরহাদুল ইসলাম প্রমুখ।