সিলেটে হাফেজ আবু তাহের হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর মামলায় প্রেমিকের মৃত্যুদণ্ড ও প্রেমিকার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড হয়েছে। গতকাল সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৪র্থ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. মঞ্জুরুল হক খান এক জনাকীর্ণ আদালতে চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। এ সময় মামলার বাদীসহ নিহতের স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও সহপাঠীরা উপস্থিত ছিলেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আবদুর রহমান (৪০) সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ গ্রামের হাজী ইব্রাহীম আলীর পুত্র ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত মনোয়ারা বেগম (৩৫) একই গ্রামের মৃত হাফেজ আবু তাহের ওরফে তাহির আলীর স্ত্রী ও ঘাতক আবদুর রহমানের ভাবী। ২০০৭ সালের ১১ই অক্টোবর পবিত্র মাহে রমজানের ২৮ তারিখ রাতে নির্মম এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। কানাইঘাট উপজেলার দিঘীরপার পূর্ব ইউনিয়নের ব্রাহ্মণ গ্রামের হাফেজ আবু তাহের ওরফে তাহির আলী সিলেটের বড়দেশ হাফিজিয়া মাদরাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। প্রতি রমজান মাসে তিনি খতমে তারাবিহ পড়াতেন। তার রয়েছে অনেক জায়গা-জমি ও বিত্ত। শিক্ষকতার কাজে বাড়ির বাইরে থাকার সুযোগে তার নিঃসন্তান স্ত্রী মনোয়ারা বেগমের সঙ্গে পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাহেরের সৎ ভাই আবদুর রহমানের। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা গোপন এ সম্পর্কের কথা জানতেন না তিনি। সম্পর্কের এক পর্যায়ে আবদুর রহমান ও মনোয়ারা বেগম হাফেজ তাহেরকে হত্যা করে সহায়-সম্পদসহ ঘর বাঁধার পরিকল্পনা করে। ঘটনার আগে পবিত্র মাহে রমজানের খতম তারাবিহ পড়াতে বাড়ির বাইরে মাদরাসা এলাকার এক মসজিদে ছিলেন আবু তাহের। ২০০৭ সালের ২৭শে রমজান খতম শেষে ২৮শে রমজান রাতে বাড়িতে আসেন তাহের। পরিবার ও ঈদের খরচ ছাড়াও খতমের হাদিয়ার সাড়ে ২৭ হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে আসেন তিনি। ওই রাতেই পরকীয়া প্রেমিক আবদুর রহমান ও প্রেমিকা মনোয়ারা বেগম হাফেজ আবু তাহেরের অণ্ডকোষ চেপে ও গলা টিপে তাকে হত্যা করে। পরে আবদুর রহমান তার নিজ ঘরে চলে যায়, মনোয়ারা থাকে নিহত স্বামীর ঘরে। সেহরির সময় মনোয়ারা তার স্বামী আবু তাহের মারা যাওয়ার কথা বলে কান্নাকাটি করতে থাকলে বাড়ির লোকজন এসে ঘটনা দেখেন। এ সময় মনোয়ারা তার স্বামীর স্বাভাবিক মৃত্যু দাবি করে তাকে দাফনের ব্যবস্থা করতে বলে। ঘাতক আবদুর রহমান লাশের গোসলের ব্যবস্থা করে এবং সে নিজে গোসল করাবে বলে জানায়। কবরও খনন করা হয় পার্শ্ববর্তী ঈদগাহের কবরস্থানে। চারদিকে মৃত্যু সংবাদ প্রচারের পর গ্রামের পশ্চিম মসজিদে এতেকাফে থাকা মওলানা মামুনুর রশীদ সন্দেহ পোষণ করেন এবং লাশের সর্বাঙ্গ দেখে আসতে পার্শ্ববর্তী গ্রামের একজন লোক পাঠান। লোকটি ঘটনাস্থলে গিয়ে লাশের সর্বাঙ্গ দেখতে চাইলে ঘাতক আবদুর রহমান ও মনোয়ারা বেগম শরীয়তের পর্দার কথা বলে কোরআনে হাফেজের নিম্নাঙ্গ দেখতে বারণ করে। এ সময় ওই ব্যক্তি আরও লোকজন জড়ো করে চাপ সৃষ্টি করলে গোসলদাতা ঘাতক আবদুর রহমান লাশের নিম্নাঙ্গ দেখাতে বাধ্য হয়। এ সময় লাশের অণ্ডকোষে জখম দেখতে পেয়ে মাওলানা মামুনকে জানায়। মাওলানা মামুন এতেকাফ থেকে বের হতে না পেরে সিলেট নগরীতে থাকা মাওলানা খলিলুর রহমানকে মোবাইল ঘটনা জানালে মাওলানা খলিল মোবাইল ফোনে কানাইঘাট থানার ওসি ও ইউপি চেয়ারম্যান আলতাফ উদ্দিনকে ঘটনা অবহিত করেন এবং পুলিশ না যাওয়া পর্যন্ত দাফনকাজ স্থগিত রাখার জন্য চেয়ারম্যানকে অনুরোধ করেন। খবর পেয়ে চেয়ারম্যান আলতাফ উদ্দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে গোসল ও কাফন স্থগিতের কথা বলেন। এ সময় লোকজনের ফাঁক দিয়ে ঘাতক আবদুর রহমান আবু তাহেরের সাড়ে ২৭ হাজার টাকাসহ দৌড়ে পালিয়ে যেতে থাকলে লোকজন পার্শ্ববর্তী কুওরেরমাটি গ্রাম থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসেন। মনোয়ারা বেগমকে ঘিরে রাখেন মহিলারা। এর মধ্যে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে লাশের সুরতহাল রিপোর্ট করে ময়নাতদন্তের জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। এ সময় পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে আবু তাহেরের রক্ত লাগা লুঙ্গি এবং ঘর থেকে আবদুর রহমান ও মনোয়ারার পরকীয়া সম্পর্কের ৩০টি নগ্ন ছবিসহ একটি অ্যালবাম আলামত জব্ধ করে। ঘাতক আবদুর রহমান ও তার পরকীয়া মনোয়ারাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই তৈয়ব আলী বাদী হয়ে কানাইঘাট থানায় মামলা করলে গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। জব্ধ করা ছবিগুলো সিআইডি’র ফরেন্সিক বিভাগ দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়। তদন্তে পরকীয়া সম্পর্কের জের ধরে হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ পেয়ে পুলিশ ২০০৮ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। বিচারের জন্য মামলাটি অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ৪র্থ আদালতে প্রেরিত হলে ২০০৮ সালের ৬ই মে চার্জ গঠনের মধ্যদিয়ে বিচারকার্য শুরু হয়। বিচারে ২৩ জনের দেয়া সাক্ষ্য প্রমাণে পরকীয়া প্রেমিক আবদুর রহমান ও প্রেমিকা মনোয়ারার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত ঘাতক আবদুর রহমানকে মৃত্যুদণ্ড ও তার বিত্ত থেকে ১ লাখ টাকা জরিমানা আদায় এবং প্রেমিকা মনোয়ারা বেগমকে মহিলা বিবেচনায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে অতিরিক্ত আরও ৫ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করেন। রাষ্ট্র পক্ষে মামলা পরিচালনা করেন এপিপি ফারুক আহমদ চৌধুরী এডভোকেট এবং আসামি পক্ষে স্টেট ডিফেন্স ছিলেন এডভোকেট এম এ মালিক।