এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমানকে ‘এনিমি অব প্রেস’ বা গণমাধ্যমের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সাংবাদিক নেতারা। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের সব সংগঠন থেকে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে।
সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনিদের বিচার দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেন সাংবাদিকরা। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), জাতীয় প্রেস ক্লাব এবং ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) যৌথভাবে এ কর্মসূচি আয়োজন করে।
সমাবেশে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা বলেন, “সাগর-রুনির রক্তের সঙ্গে তোমরা বিশ্বাস ঘাতকতা করো না এবং দুই সাংবাদিক ইউনিয়নের মাঝের দেয়াল ভেঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হও।”
সব সাংবাদিক সংগঠনের ঐক্যবদ্ধ এই কর্মসূচিতে এটিএন বাংলার প্রধান বার্তা সম্পাদক ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী কিছুক্ষণ উপস্থিত থেকে পরে চলে যান। রোববার একই ধরণের কর্মসূচিতে এটিএনের কর্মীদের উপস্থিতি ছিল প্রায় ৩০ জন।
ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “মাহফুজুর রহমান সাগর-রুনি সম্পর্কে অশালীন এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে মিথ্যা অভিযোগ করেছেন তা তিনি প্রত্যাহার করেননি উল্টো সাংবাদিক ঐক্য বিনষ্ট করতে তার লোকজনকে লেলিয়ে দিয়েছেন। সেজন্য রোববার এটিএনের কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মী আমাদের ঐক্যের ওপর হামলা করেছে। তার এই অপকৌশলের সমুচিত জবাব আমরা দিতে চাই। আজ আমরা আরো সাহসী হয়েছি।”
তিনি বলেন, “মাহফুজুর রহমানের অবস্থান সাংবাদিকদের ঐক্যের বিরুদ্ধে। সাগর-রুনি সম্পর্কে মানহানিকর মন্তব্য করে তিনি হাই কোর্টের নির্দেশ ভঙ্গ করে হত্যাকাণ্ডের তদন্তকে বিভ্রান্ত করতে উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। বলেছেন, তার কাছে প্রমাণ হিসেবে ভিডিও ফুটেজ আছে। সর্বশেষ তার অফিসে আমাদের সহকর্মীদের নির্দেশ দিলেন, যেনো এখানে এসে উচ্ছৃঙ্খলতা করে। এসব অভিযোগে আমরা সাংবাদিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে তাকে ‘এনিমি অব প্রেস’ বা গণমাধ্যমের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করতে চাই। যেহেতু তিনি আমাদের শত্রু, তাই আজ থেকে সাংবাদিকদের সব সংগঠন থেকে তাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করছি।”
ইকবাল সোবহান বলেন, “নীতিমালা ভঙ্গ করে এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ সাংবাদিকদের ঐক্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এজন্য টক-শো এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান প্রচার করছে তারা। সেগুলো বন্ধ করতে সাংবাদিক বন্ধুদের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। আমরা কেউই ওইসব অনুষ্ঠানে অংশ নেবো না।”
“মাহফুজুর রহমানের এমন অবস্থানের কারণে অবিলম্বে তার গ্রেফতার দাবি করছি” বলেন তিনি।
রোববার মানববন্ধনে উচ্ছৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় ১০ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। তারা হলেন- জ.ই মামুন, নাদিরা কিরন, এসএম বাবু, মানস ঘোষ, কেরামত উল্লাহ বিপ্লব, ভানুরঞ্জন চক্রবর্তী, রাহাত মিনহাজ, শওকত মিল্টন, মাহমুদুর রহমান, শামিম আহমেদ।
এই ১০ সাংবাদিকের পক্ষে কেউ অবস্থান নিলে তার বিরুদ্ধেও সাংবাদিক নেতারা ব্যবস্থা নিবেন বলে জানান ইকবাল সোবহান।
এটিএনের মালিকপক্ষ কোনো কারনে তাদের কর্মীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে সেসব কর্মীদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দেন এই সাংবাদিক নেতা। “কেউ নিজের স্বার্থের জন্য নয়, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার জন্য দলমত নির্বিশেষে পুরো সাংবাদিক সমাজ আজ ঐক্যবদ্ধ।” বলেন ইকবাল সোবহান চৌধুরী।
তিনি এটিএনের কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা মালিকের পক্ষে থাকবেন নাকি সাগর-রুনির বিচারের পক্ষে থাকবেন, সে সিদ্ধান্ত আপনাদের নিতে হবে।”
হত্যাকাণ্ডের তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত র্যাব সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “জামাইআদরে মাহফুজুর রহমানকে কী জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন- আমরা তা জানতে চাই। আর তদন্তের অগ্রগতি নয়, খুনিদের উপস্থাপন চাই। যদি তা না পারেন, তাহলে তদন্তের নামে তামাশা করবেন না। আমরাই তদন্তের মাধ্যমে জাতির সামনে হত্যাকারিদের উপস্থাপন করবো।”
বিএফইউজের আরেক সভাপতি রুহুল আমিন গাজী সরকারের উদ্দেশে বলেন, “সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড তদন্তকারী সংস্থার ব্যর্থ কর্মকর্তারা কেনো এখনো চাকরিতে আছে?”
তিনি বলেন, “এটিএনের গুন্ডাবাহিনী কীভাবে জাতীয় প্রেস ক্লাবে হামলা করেছে, তা আমরা দেখেছি।”
এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ.ই মামুনের উদ্দেশে তিনি বলেন, “আমরা আপনাদের ওপর হামলা করলে সেই ভিডিওচিত্র প্রচার করুন। নইলে যে মিথ্যা প্রতিবেদন রোববার আপনারা প্রচার করেছেন, তা প্রত্যাহার করুন।”
“এটিনের হলুদ সাংবাদিকতা বিশ্বের সব হলুদ সাংবাদিকতাকে ম্লান করে দিয়েছে।” মন্তব্য করেন রুহুল আমিন গাজী।
র্যাব সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, “মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে আপনাদের এতো কিসের পিরিত? তাকে গ্রেফতার করে হত্যাকাণ্ডের তথ্য-প্রমাণ না নিলে আপনাদের বিরুদ্ধেও আমরা ব্যবস্থা নেব।”
“সরকার যদি মাহফুজুর রহমানের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করে, তাহলে আমরাও সে ব্যাপারে অবস্থান নেবো”, যোগ করেন তিনি।
নিউজ টুডে সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন আহম্মদ বলেন, “এটি পরিষ্কার যে, মাহফুজুর রহমান নিজেই সাগর-রুনি হত্যার দায় গায়ে নিয়েছেন। তদন্তকারী সংস্থাগুলো তাকে ধরলে এ সম্পর্কে জানতে পারবে।”
তিনি বলেন, “গতকাল এটিএন কর্মীরা যে দৃশ্য দেখিয়েছেন, তা গত চার দশকে আমার প্রথম দেখা। এদের সাংবাদিক বলতে লজ্জা হয়। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই।”
বিএফইউজের মহাসচিব শওকত মাহমুদ বলেন, “সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সাংবাদিকদের ঐক্যে স্ফূলিঙ্গের মতো কাজ করছে।কোনো কোনো মহল এই ঐক্য ও আন্দোলন বিনষ্টের চেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, “আমরা মনে করেছি মাহফুজুর রহমানের বক্তব্য একটি প্রলাফ মাত্র। আসলে তা নয়। সাগর-রুনি সম্পর্কে যে অশালীন এবং সাংবাদিকদের জড়িয়ে যে মিথ্যা অভিযোগ তিনি করেছেন তা প্রতিষ্ঠিত করতে চাচ্ছেন।”
“মাহফুজুর রহমানকে হুঁশিয়ার করে বলতে চাই, সাংবাদিক সমাজ মালিকপক্ষ বা কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় পায় না। আপনি সাংবাদিকদের শত্রু হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। সাগর-রুনিসহ অন্যান্য সাংবাদিক হত্যার বিচার হওয়া পর্যন্ত আমাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চলবে।” বলেন তিনি।
“মাহফুজুর রহমান বলেছেন হত্যাকাণ্ডের দিন রুনির স্বামী সাগর ভোর ছ’টার দিকে বাসায় ফেরার কথা, কিন্তু তার আগেই রাতে ফিরেছেন। কোনো চ্যানেলের মালিক যখন তার অধিনস্থ নারী সাংবাদিকের স্বামী কখন বাসায় ফিরবেন সে সময়ের খোঁজ রাখেন, তখন আমরা এমন মালিককে নিয়ে আতঙ্কবোধ করি। মোহনা টিভির মালিক কামাল মজুমদারও আরটিভির রিপোর্টার অপর্ণা সিংহের গায়ে হাত তুলেছেন।”, যোগ করেন শওকত মাহমুদ।
এটিএনের মালিকানা পুনঃবিবেচনার জন্যও সরকারের প্রতি দাবি জানান তিনি।
আরেক মহাসচিব আব্দুল জলিল ভূঁঞা বলেন, “যারা গতকাল হামলা করেছে তারা সাংবাদিক নামের কলঙ্ক। সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে ফাটল ধরাতে এ হামলা চালানো হয়েছে। মাহফুজুর রহমানের দালালদের চিহ্নিত করতে হবে। র্যাব কি মাহফুজুর রহমানকে ধরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে না? হাউসে যেয়ে কিসের এতো পিরিতি?”
জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ বলেন, “মাহফুজুর রহমান জনগণ থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যাননি। সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার আমরা সব সাংবাদিক চাই। গণতন্ত্র রক্ষায় সাংবাদিকরা নিরাপদে দায়িত্ব পালন করতে চায়। কেউ আমাদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করলে সেটি ভুল হবে।”
ডিইউজে’র সভাপতি আব্দুস শহিদ বলেন, “পাঁচ মাস ধরে আমরা আন্দোলন করছি। কোনোদিন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। গতকাল এটিএনের ৩০-৩৫ জন লোক এসেছে। তারা একজন সাংবাদিককে আক্রান্ত করেছে। মাহফুজুর রহমান ভুল পথে হেঁটে অপরাধের সঙ্গে আরো বেশি জড়িয়ে যাচ্ছেন। সাগর-রুনির খুনিরা গ্রেফতার হবেই।”
আরেক সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, “আমরা যেন আন্দোলন না করি, সেজন্য হামলা চালানো হয়েছে। মাহফুজুর রহমান আপনি পার পাবেন না। হত্যাকারীদের ধরিয়ে দিন, নয়তো এটিএন বাংলা ও এটিএন নিউজ বয়কট করা হবে। অন্য যে কয়েকটি চ্যানেল মাহফুজুর রহমানের পক্ষ নেয়ার চেষ্টা করছেন, তাদের বলছি- আমরা আপনাদের শত্রু নই। আপনারা খুনির পক্ষ নেবেন না।”
ডিআরইউর সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা বলেন, “আন্দোলনের পেছনে কেউ কেউ ছুরিকাঘাত করে আমাদের ফ্লাটফর্ম ভাঙার চেষ্টা করছেন। আপনারা ফ্লাটফর্মে থাকবেন কি না সেটা আপনাদের বিষয়। প্রয়োজনে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।”
“গতকাল একদল উচ্ছৃঙ্খল সাংবাদিক আমাদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করেছে।তাদের জন্য নেতৃবৃন্দ কী শাস্তির ব্যবস্থা নেন দেখবো। উপযুক্ত শাস্তির সিদ্ধান্ত নেয়া না হলে ডিআরইউ এককভাবে সিদ্ধান্ত নেবে। আশা করি নেতারা এমন সিদ্ধান্ত নেবেন যেন আমাদের ঐক্য বিনষ্ট না হয়। কতিপয় সাংবাদিক বা কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য পুরো সাংবাদিক সমাজের ঐক্য বিনষ্ট হতে পারে না।” বলেন তিনি।
অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন, ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক বাকের হোসাইন ও শাবান মাহমুদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবদাল আহমেদ।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ডিআরইউর সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ আলম খান তপু।
বেলা আড়াইটার দিকে বিক্ষোভ মিছিলের মাধ্যমে সাংবাদিকরা কর্মসূচি শেষ করেন।
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অনুষ্ঠিতব্য সমাবেশে সব সাংবাদিককে অংশ নেয়ার আহবান জানানো হয়েছে। সমাবেশ শেষে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে পদযাত্রা করবেন তারা। সেখানে প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি প্রদানের মাধ্যমে সাংবাদিকদের বিভিন্ন দাবি জানানো হবে।