বার্তা ৭১ ডটকম: বেঁচে থাকলে ৭২ বছরে পা রাখতেন হুমায়ুন ফরীদি। কিন্তু সে যাত্রার সাঙ্গ হয় ২০১২ সালেই। লাখো ভক্ত ও অনুরাগীদের কাঁদিয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি চলে যান কিংবদন্তি এ অভিনেতা। আজ তার জন্মদিন।
ফরীদিকে নিয়ে রয়েছে অনেক বিশেষ ব্যক্তির স্মৃতিচারণ। কেউ ফরীদির সঙ্গে কাজ করার সুবাদে গেয়েছেন তার গুণগান, কেউবা বলেছেন ফরীদির সাথে ক্যাম্পাস জীবনে কাটানো সুখকর সময়গুলো নিয়ে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের চোখে ফরীদি সমাজতান্ত্রিক সমাজ চাইতেন। স্মৃতিচারণ করে আনু বলেন, ফরীদির সঙ্গে আমার পরিচয় ১৯৭৫-এর শেষে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকের পাড়ে, হাঁটতে হাঁটতে মুখোমুখি হওয়ার পর পর। তখন অর্থনীতি বিভাগ যে ভবনে, তার থেকে বের হলেই পর পর কয়েকটি লেক। আমি তখন অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ করছি, ফরীদি তত দিনে ভর্তি হয়ে গেছে। বন্ধুত্ব হতে সময় লাগল না।
আমি প্রথমে ছিলাম মীর মশাররফ হোসেন হলে। ফরীদি থাকত আলবেরুণী এক্সটেনশনে। ওর উদ্যোগেই আমি ও মনজু চলে এলাম এই হলে। এই হল ছিল এক তলা, খুবই খোলামেলা। ভেতরে ঝাউগাছ, সামনেই লেক। হলের বারান্দা আর লেকের পাড়ও ছিল আমাদের বসার জায়গা। এই হলের নাম এ রকম, কী করে হয়? আমরা সবাই মিলে ঠিক করলাম হলের নতুন একটা পরিচয় দেওয়ার। আমরা নাম ঠিক করলাম ‘শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ছাত্রাবাস’। হাতে লিখে সাইনবোর্ড লাগানো হলো। ঢাকা থেকে এই ঠিকানা চিঠি পাঠিয়ে নাম চালু করতে চেষ্টা করলাম। ফরীদি এরকমই।
ফরীদি একদিন বলেন, ‘আমি সমাজতন্ত্র চাই, কেন জানো? চাই এ কারণে যে সমাজতন্ত্র হলে আমি শুধু নাটক করেই জীবন পার করতে পারব। অর্থের জন্য, জীবিকার জন্য আমার কোনো চিন্তা করতে হবে না। ’
ফরীদিকে নিয়ে কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতিচারণ একটু অন্যরকম। ‘ফরীদিকে স্মরণ’ নামের একটি লেখায় হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক সালেহ চৌধুরীর মাথায় (কাজকর্ম তেমন ছিল না বলেই মনে হয়) অদ্ভুত অদ্ভুত আইডিয়া ভর করতো। একদিন এ রকম আইডিয়া ভর করল। তিনি আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় উপস্থিত হয়ে বললেন, বাংলাদেশে পাঁচজন হুমায়ূন আছে। দৈনিক বাংলায় এদের ছবি একসঙ্গে ছাপা হবে। আমি একটা ফিচার লিখব, নাম ‘পঞ্চ হুমায়ূন’। আমি বললাম, পাঁচজন কারা? সালেহ চৌধুরী বললেন, রাজনীতিবিদ হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী, দৈনিক বাংলার সম্পাদক আহমেদ হুমায়ূন, অধ্যাপক এবং কবি হুমায়ূন আজাদ, অভিনেতা হুমায়ুন ফরীদি এবং তুমি। আমি বললাম, উত্তম প্রস্তাব তবে এখন না। আরও কিছুদিন যাক। সময় যেতে লাগল, হুমায়ূনরা ঝরে পড়তে শুরু করলেন। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী গেলেন, আহমেদ হুমায়ূন গেলেন, হুমায়ূন আজাদ গেলেন।
হুমায়ূন আহমেদ খানিকটা হা হুতাশ নিয়েই শেষে বললেন, হারাধনের পাঁচটি ছেলের মধ্যে রইল বাকি দুই। এই দু’জনের মধ্যে কে আগে ঝরবেন কে জানে! অদ্ভুত বিষয় হলো হুমায়ূন ফরীদির সাথে একই বছর গত হন কিংবদন্তি এ কথাসাহিত্যিক।
হুমায়ূন আহমেদের আরেক গল্পে উঠে আসে সেসময়ে ফরীদির তুমুল জনপ্রিয়তার কথা। শুরু করলেন প্রথম পরিচয়ের গল্প দিয়ে। ফরীদির তখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। বিটিভির অভিনয় রাজ্য দখল করে আছেন। একদিনের কথা, বেইলি রোডে কী কারণে যেন গিয়েছি, হঠাৎ দেখি ফুটপাতে বসে কে যেন আয়েশ করে চা খাচ্ছে। তাকে ঘিরে রাজ্যের ভিড়। স্ট্রিট ম্যাজিশিয়ানরা ম্যাজিক দেখানোর সময় তাদের ঘিরে এ রকম ভিড় হয়। কৌতূহলী হয়ে আমি এগিয়ে গেলাম। ভিড় ঠেলে উঁকি দিলাম, দেখি হুমায়ুন ফরীদি- চা খাচ্ছেন, সিগারেট টানছেন। রাজ্যের মানুষ চোখ বড় বড় করে দৃশ্য দেখছে; যেন তাদের জীবন ধন্য। হঠাৎ ফরীদির আমার উপর চোখ পড়ল। তিনি লজ্জিত গলায় বললেন- আপনি এখানে কী করেন? আমি বললাম, আপনার চা খাওয়া দেখি। ফরীদি উঠে এসে আমার হাত ধরে বললেন, আশ্চর্য ব্যাপার। মিতা! আসুন তো আমার সঙ্গে। (নামের মিলের কারণে আমরা একজনকে অন্যজন মিতা সম্বোধন করি) তিনি একটা মনিহারী দোকানে আমাকে নিয়ে গেলেন। সেলসম্যানকে বললেন, আপনার দোকানের সবচেয়ে ভালো কলমটি আমাকে দিন। আমি মিতাকে গিফট করব। ফরীদিকে আমি একটি বই উৎসর্গ করেছি। উৎসর্গ পাতায় এই ঘটনাটি উল্লেখ করা আছে।
বিদেশ বসেও ফরীদিকে হুমায়ুন আহমেদ স্মরণ করেছেন এভাবে- স্থান সুইডেন, কাল ২০০৮, পাত্র মানিক। এই ভদ্রলোকের সুইডেনে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। তিনি একদিন নিমন্ত্রণ করলেন তার বাড়িতে। দেশের বাইরে গেলে আমি কোথাও কোনো নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি না। কারো বাড়িতে তো কখনো না। মানিক সাহেবের বাড়িতে গেলাম, কারণ তার চেহারা অবিকল হুমায়ূন ফরীদির মতো। আপন ভাইদের চেহারাতেও এত মিল থাকে না।
ভদ্রলোককে এই কথা জানাতেই তিনি বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন, অনেকেই এমন কথা বলে। আমি বললাম, ফরীদির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কোনো পরিচয় কি আছে? মানিক বললেন, সে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ১৯৭১ সালে আমি ও ফরীদি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেছি। আমি চমকালাম! ফরীদি যে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তা আমার জানা ছিল না। মানিকের বাড়িতে আমার জন্য আরও বড় চমক অপেক্ষা করছিল।
হুমায়ূনের ভাষায়, সেখানে মানিকের বাড়ির সবচেয়ে সুন্দর ঘরটির নাম ফরীদি। এই ঘরটি তিনি সারাবছর তার বন্ধু হুমায়ুন ফরীদির জন্য সাজিয়ে রাখেন। যদি ফরীদি বেড়াতে আসেন। অন্য কারও সেই ঘরে প্রবেশাধিকার নেই।
হুমায়ুন ফরীদির আরেকটি গল্প কিছুটা পরিমার্জিত করে এ কথাসাহিত্যিক উল্লেখ করেছেন তার লেখায়। ঘটনাটা এমন- ‘স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া হয়েছে। ফরীদি স্ত্রীর রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেছেন। রাগ ভাঙাতে পারেননি। সুবর্ণা কঠিন মুখ করে ঘুমাতে গেছেন। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙতেই সুবর্ণা হতভম্ব। ঘরের চারপাশের দেয়াল জুড়ে ফরীদি লিখে ভর্তি করে ফেলেছে। লেখার বিষয়বস্তু ‘ সুবর্ণা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ‘