বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ মানছেন না ভার্সিটি ব্যবসায়ীরা। ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় আইনকে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্য করছেন। আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে ফ্রি স্টাইলে চলছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইম ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউওডা), নর্দান ইউনিভার্সিটি, দি পিপলস ইউনিভার্সিটি, রয়েল ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, অতিশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল প্রমুখ।
প্রায় দশ বছর ধরে নীতিভ্রষ্ট ব্যবসায়ী দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে সারা দেশে শাখা ক্যাম্পাস স্থাপন করে উচ্চশিক্ষার সনদ বিক্রি করছে।
এ প্রতিষ্ঠানের নামে সম্প্রতি রাজধানীর খিলগাঁও, দক্ষিণ বনশ্রীসহ বিভিন্ন এলাকায় আরও অর্ধশত ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে। দুর্নীতিগ্রস্ত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক ব্যবসায়ীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে শিক্ষা প্রশাসন। প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই চলছে অনাচার, দুর্নীতি, সনদ-বাণিজ্য ও মালিকানা দ্বন্দ্ব। গত সাড়ে তিন বছরে একটি প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও মালিকানা দ্বন্দ্বও নিরসন করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বর্তমানে আইন নয় কেবল প্রভাবশালীদের স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতার দাপট ও অনৈতিক তদবিরের চাপেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
সূত্র জানায়, প্রায় সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চলছে লাগামহীন সার্টিফিকেট-বাণিজ্য। চলছে মালিকানা বিরোধ, বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার এবং শাখা ব্যবসা।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ মানছে না কমপক্ষে ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়। এ আইনকে উপেক্ষা করে চলছে তাদের সিন্ডিকেট, ট্রাস্টি বোর্ড ও ফাউন্ডেশন গঠন।নিয়োগ দেয়া হচ্ছে অযোগ্য উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, শিক্ষক-কর্মকর্তা এবং ইচ্ছামতো ভর্তি করছেন শিক্ষার্থী। কিন্তু প্রভাবশালীদের দৌরাত্ম্যের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে শিক্ষা প্রশাসন।
তবে শিক্ষামন্ত্রীর নানামুখী তৎপরতা ও হুমকিতে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাস নির্মাণ, ক্যাম্পাসের জন্য জমি ক্রয় কিংবা ক্যাম্পাস নির্মাণের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
ইউজিসি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে দুর্নীতিগ্রস্ত বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদন প্রণয়ন করলেও সেগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পরই থমকে যায় এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। প্রতিবেদন নিয়ে চলে অনৈতিক বাণিজ্য। শিক্ষামন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের কারণে দুয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্তের ফাইল সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হলে সেখানেও প্রতিবেদন নিয়ে চলে নানা কা-কীর্তন। এ পরিস্থিতিতে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, মালিকদের অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও সনদ ব্যবসা নিয়ে তদন্ত করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে ইউজিসি। সম্প্রতি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ-বাণিজ্য ও মালিকানা দ্বন্দ্ব চরম বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নীরব-নির্বিকার শিক্ষা প্রশাসন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, যারা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে শিক্ষা-বাণিজ্য করছেন, তারা সমাজের অনেক ক্ষমতাধর। ইচ্ছা করলেই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। এরপরও যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আসছে, রুটিনওয়ার্ক হিসেবে তাদের কার্যক্রম তদন্তপূর্বক কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু জবাব দিচ্ছে না কেউ।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ইউজিসি এক্সিকিউটিভ বডি নয়। তাই আমরা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না। তা ছাড়া এবার আমরা তো দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের (নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি) দুর্নীতির বিষয়ে একটি শক্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছি।
কিন্তু কিছুই করতে পারলাম না। তিনি জানান, আগামী সপ্তাহ থেকে ইউজিসির একটি পরিদর্শন টিম নিয়মিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম মনিটরিং করবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) ওপর এখন সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ১৯ জন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি সদস্যের মধ্যে ৬-৭ জন ট্রাস্টি সদস্য নিজেদের মতো করে এনএসইউ পরিচালনা করছেন। এ প্রতিষ্ঠানের প্রভাবশালী ট্রাস্টি সদস্যের কালোটাকার দৌরাত্ম্যের কাছে অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
অবিলম্বে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখার কার্যক্রম বন্ধ করতে প্রায় ছয় মাস আগে সরকার গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন সুপারিশ করলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় তা বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে যারা সনদ-বাণিজ্য করছে তারা সবাই বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছেন। একজন প্রতিমন্ত্রীর ভাইও এ প্রতিষ্ঠানের সনদ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
সনদ-বাণিজ্য ও তহবিল ভাগবাটোয়ারা নিয়ে সম্প্রতি এশিয়ান ইউনিভার্সিটির মালিকরা একপক্ষ অপরপক্ষকে বহিষ্কার করেছেন। একই ঘটনা ঘটেছে রয়েল ইউনিভার্সিটি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি এবং অতিশ দীপংকর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর প্রাইম ইউনিভার্সিটির মালিকরা দুভাগে বিভক্ত হয়ে একপক্ষ অপরপক্ষকে অবৈধ আখ্যায়িত করে নিয়মিত গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রচার করছেন। এতে এই প্রতিষ্ঠানের দুই গ্রুপের প্রায় আট হাজার ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাজীবন এখন হুমকির মুখে।
প্রায় নয় বছর ধরে অবৈধ উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ ছাড়াই চলছে ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি। প্রায় সাড়ে তিন বছর ধরে অবৈধভাবে ইউওডার উপাচার্যের পদে বহাল আছেন বিএনপিপন্থি শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমেদ। উপাচার্য হিসেবে বৈধভাবে তার নামের প্রস্তাব চ্যান্সেলরের কাছে না পাঠানোতে তাকে অনুমোদন দিচ্ছে না সরকার। ড. আলিমুল্লাহ মিয়া ১৯৯৩ সাল থেকে প্রায় ১৮ বছর ধরে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) উপাচার্যের পদে আছেন।