বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা ডব্লিউএইচও’র তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী ৩৪৬ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে আক্রান্ত৷ ২০৩০ সাল নাগাদ গোটা বিশ্বে আনুমানিক ৭.৮ শতাংশ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে৷
বর্তমানে চীন ও ভারতে দেখা যাচ্ছে এর প্রকোপ৷ নতুন সমীক্ষা অনুযায়ী, ভারতে ৫১ মিলিয়ন মানুষ ডায়বেটিসে ভুগছেন৷ আগমী ২০ বছরে এই সংখ্যা ১৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ দিল্লি, মুম্বাই ও কলকাতার মতো বড় বড় শহরে ডায়বেটিস রোগীরা একই ধরনের সমস্যার কথা বলেন চিকিত্সকের কাছে, যেমন অফিসে চেয়ারে বসেই কাজ করতে হয় অনেকটা সময়, খেলাধুলা ও স্বাস্থ্যকর খাবারের সুযোগ সুবিধাও কম৷ পুষ্টিকর খাদ্য দ্রব্য ও রান্নাবান্নার সময়ও পান না অনেকে৷ চারিদিকে, কোকাকোলা, পিৎসা ও বার্গারের মতো ফাস্টফুডের বিজ্ঞাপন৷ একটু স্বচ্ছল হলেই গাড়ি কেনার প্রবণতা৷ ঘরকন্নার সাহায্যে থাকে কাজের লোক৷ শারীরিক পরিশ্রমের পাল্লাটা অনেক কম ইত্যাদি ইত্যাদি৷ আর এসবই বহুমূত্র রোগের দিকে ঠেলে দেয় মানুষকে৷
জার্মান ডায়বেটিস সমিতির প্রধান হেরমান লিলিয়েনফেল্ড এই রোগটির ব্যাপারে একটা অন্ধকার চিত্রই তুলে ধরলেন৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘সমগ্র অর্থনীতির জন্যই এটা একটা বিরাট চাপ৷ তবে এটাও মনে রাখতে হবে, বেশির ভাগ মানুষই যথেষ্ট খাবার পায় না৷ পাশ্চাত্যের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার সঙ্গে যারা তাল মিলিয়ে চলেন, তাদেরই ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি৷ তবে এই সাথে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থারও উন্নয়ন প্রয়োজন৷’’
ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও ১৯৯১ সালে অর্থনীতির বাজার মুক্ত করে দেয়ার পর, ভারতের অর্থনীতিও ফুলে ফেঁপে উঠেছে৷ ২০ বছরের মধ্যে মাথা পিছু আয় চার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে৷ দারিদ্র্যের ভয়াবহতাও অনেকটা কমেছে৷ নিরক্ষরতার সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে৷ এই সব উন্নয়নই বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে, যদি ডায়বেটিসের মতো রোগ ব্যাধি গোটা প্রজন্মকে বিধ্বস্ত করে ফেলে৷
বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মই ঝুঁকির মুখে৷ ভারতে ডায়বেটিসে আক্রান্তদের গড় বয়স এখন সাড়ে বেয়াল্লিশ বছর৷ পশ্চিমের দেশগুলির তুলনায় অনেক কম৷ এমনিতেই ভারতের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ম্যালেরিয়া, পোলিও, যক্ষ্মা, লেপ্রা ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে৷ স্বাস্থ্যবিমা এখনও বেশির ভাগ মানুষের কাছেই অপরিচিত৷ ভারতের মাত্র পাঁচ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্য বিমার সুফল ভোগ করেন৷
চিকিত্সা ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য বহু পুরস্কারে ভূষিত ড. কে. কে. আগরওয়াল৷ এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘এই ভাবে ভারতে যদি ডায়বেটিস রোগটি মহামারির আকার নিতে থাকে, তা হলে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অন্ধ, হৃদরোগ ও অঙ্গহীন মানুষের বাসস্থান হবে দেশটি৷ দুর্ভাগ্যবশতঃ এখন পর্যন্ত ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণের তেমন কোনো কর্মসূচি নেই ভারতে৷ হৃদরোগের রক্ত সঞ্চালন ও মেদ জনিত অসুখ বিসুখের ব্যাপারে কিছু কিছু প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়া হলেও এক্ষেত্রে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে৷ আর তা না হলে এ ব্যাপারে পরিবর্তন আসবে না৷’’
তবে ভারত সরকার সরকার স্বাস্থ্য খাতে ব্যয়ের পরিমাণ এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে তিন শতাংশে করার ঘোষণা দিয়েছে৷ বিশ্বব্যাংকের অনুমান, ডায়বেটিস ও হৃদরোগের মত ব্যাধির কারণে ভারত সরকার প্রতি বছর ২৩ বিলিয়ন ডলার হারাচ্ছে৷ এই সব অসুখ বিসুখের প্রকোপ না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চার শতাংশ বেশি হতে পারতো৷
ডায়বেটিস গবেষক লিলিয়েনফেল্ড এর ভাষায়, ‘‘এই রোগটি নিয়ে সুন্দর একটি বাক্য আছে: চিনি ব্যথার সৃষ্টি করেনা তাই খুব খারাপ কিছু হওয়ার কথা নয়৷ ডায়বেটিসে আক্রান্ত হলে এই রকমটি মনে হতে পারে প্রথম দিকে৷ তার মানে, যে সময়টাতে শর্করার উপস্থিতি তেমন ভাবে অনুভব করা যায় না, ঠিক তখনই রোগটি দানা বাধতে থাকে, যেটা আবার পরে বোঝা যায়৷ যেমন দেখা দেয় হৃদযন্ত্রের সমস্যা, স্ট্রোক, চোখ বা কিডনির সমস্যা৷ এই সব সমস্যা দেখা দিলে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়, রোগটি ততোদিনে চলে যায় আয়ত্তের বাইরে৷’’
দৃষ্টিশক্তি বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো ভারতের মতো কোনো দেশের মানুষের পক্ষে অসহনীয় এক অবস্থা৷ সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভরশীল এক জীবন অতিবাহিত করতে হয় ভুক্তভোগীদের৷ হারাতে হয় আত্মসম্মান৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, ডায়বেটিস মহামারিকে দ্রুত আয়ত্তে আনতে না পারলে ফলাফল ভয়ানক হবে৷সূত্র: ডয়েচে ভেলে