ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে প্রেম প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন শিক্ষার্থীরা। অহরহ ঘটছে ব্ল্যাকমেইলিং। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে ভাড়া বাসায় বসবাস। অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি গোপনে ভিডিও করা। এরপর তা আবার ইন্টারনেটে ছেড়ে দেয়াসহ নানা ঘটনাই ঘটছে। এসব তদন্ত করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিব্রত। প্রক্টর ড. আমজাদ আলী বার্তা৭১ডটকমকে বলেন, আমরা ক্লান্ত। এসব প্রতারণার অন্যতম মাধ্যম প্রেম। এরপর ঘটে নানা ঘটনা।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রে মেয়ে আবার অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরাও প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছেন। গত মাসে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এম ফিলের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে অবাক করার মতো অভিযোগ করেছেন। ওই ছাত্রী প্রেম করে বিয়ে করেছে দুই বছরের জুনিয়র নৃবিজ্ঞান বিভাগের মাস্টার্সের এক ছাত্রকে। বিবাহের প্রথম রাতের অন্তরঙ্গ দৃশ্যগুলো ওই ছাত্র তার অগোচরেই ভিডিও করে। বিয়ের সপ্তাহ না পেরোতেই সে ছবির মাধ্যমে শুরু করে ব্ল্যাকমেইল। ডিভোর্স দেয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে স্ত্রীকে। বিভিন্নভাবে শারীরিক নির্যাতনের পাশাপাশি অর্থের জন্যও চাপ দিতে থাকে স্ত্রীকে। আর না হলে অন্তরঙ্গ ভিডিও মানুষের মোবাইলে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে কোথাও জায়গা খুঁজে দিতে সাহায্য নেন দূর সম্পর্কের আত্মীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরই ম্যানেজমেন্ট বিভাগের এক শিক্ষার্থীর কাছে। আত্মীয়তার সুযোগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ে। গড়ে ওঠে প্রেম। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে বিজিবি গেটে বাসা ভাড়া নেয়। একদিন খুলনায় একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেয়ার কথা বলে ওই ছাত্রীকে খুলনায় নিয়ে যায় ওই ছাত্র। কিন্তু কোন কোচিংয়ে না গিয়ে ওঠে এক বন্ধুর বাসায়। রাতে ঘুমের ট্যাবলেট খাইয়ে চালানো হয় ছাত্রীর ওপর পাশবিক নির্যাতন। আর ছাত্রীর অগোচরেই সে সব চিত্র ভিডিও করে অপর বন্ধু। আরও কুৎসিত রূপ বের হয়ে পড়ে ওই ছাত্রের। প্রতিনিয়ত শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর জন্য চাপ দেয় ছাত্রীকে। রাজি না হলে ভিডিও ও তোলা ছবি সবাইকে দেখিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। বাধ্য হয়ে দীর্ঘদিন স্ত্রীর মতোই বসবাস করে ওই ছাত্রী। এর মধ্যে ছাত্রের বন্ধুদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। কেবল বন্ধুই নয়, বিভিন্ন সময় বাইরের লোকদের টাকার বিনিময়ে শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে বাধ্য করা হয় তাকে। নির্যাতন নয় শুধু, ছাত্রীর বাড়ি থেকে পাঠানো টাকাও কেড়ে নিতো ওই ছাত্র। আর ছাত্রীকে চলতে হতো টিউশনি করে। কিন্তু তার কথিত প্রেমিকের অত্যাচারের মাত্রা তীব্র হলে মুখ খোলে প্রেমিকা। বাবা-মাকে খুলে বলে সব কিছু। তার প্রেমিকও অন্তরঙ্গ ভিডিও ও ছবি ছাত্রীর বাবা-মা ও বিভাগের শিক্ষকদের কাছে পাঠায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মোবাইলে ছড়িয়ে পড়ে সে ছবি ও ভিডিও। আস্তে আস্তে মেয়েটি অন্ধকার পথে পা বাড়ায়। শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়ে একটি বছর।
১৮ মাসে এ ধরনের প্রায় ১০টি ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে ৩টি ঘটনার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কাছেও অভিযোগ এসেছে ৭টি ঘটনার। অনেক সময় নির্যাতনের শিকার ছাত্রীরা মান-সম্মানের ভয়ে এ ঘটনা কারও কাছে প্রকাশ করে না। ১৪ই মে বাংলা বিভাগের ৩য় বর্ষের এক ছাত্রী গোসল করা অবস্থায় দেখতে পায় বাথরুমের দেয়ালে ছিদ্র, সেখানে ক্যামেরা মোবাইল লাগানো। ঘটনার পরে চিৎকার শুরু করলে বাসার অন্যরা এসে স্থানীয় একটি ছেলেকে বাসার ভিতর থেকে আটক করে। ওই ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে বিষয়টি জানালে তিনি লালবাগ থানার সহায়তায় তাকে আটক করেন। ওই ছেলেটির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যান। কিন্তু ফেসবুকে ওই ছাত্রীর সঙ্গে অন্য একটি ছেলের কিছু অন্তরঙ্গ ছবি ও আপত্তিকর মন্তব্যের কারণে তার স্কলারশিপ বাতিলের কথা বলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষ। পরে ওই ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের অনুসন্ধানে পাওয়া যায় ওই ছাত্রীর ছবিগুলো ফেসবুকে ছড়িয়েছেন ঢাবি’র জগন্নাথ হলের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক ছাত্র। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। ছবিগুলো কম্পিউটারের মাধ্যমে তৈরি করে ফেসবুকে ছাড়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়লা নামের এক শিক্ষার্থী সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়েছে বলে প্রক্টরের কাছে অভিযোগ করেছে। সে জানায় মুহসীন হলের তার বিভাগেরই এক ছাত্র ফেসবুকে তার নামে ভুয়া আইডি খোলে। সেখানে কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য ও বিভিন্ন নোংরা ছবি পোস্ট করে বিভিন্ন জনের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। এমনকি একাউন্টটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এক ছাত্রের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল ইডেন কলেজের এক ছাত্রীর। দীর্ঘদিন প্রেমের এক পর্যায়ে তারা স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নেয়। জড়িয়ে পড়ে শারীরিক সম্পর্কে। আর এ অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি তুলে রাখে প্রেমিক। এরপরে এ ছবি প্রকাশের ভয় দেখিয়ে কথিত প্রেমিকার সঙ্গে প্রায়ই শারীরিক সম্পর্কে মিলিত হতো প্রেমিক। বিয়েরও আশ্বাস দেয় প্রেমিকাকে। এক পর্যায়ে প্রেমিকা বিয়ের জন্য চাপ সৃষ্টি করলে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে প্রেমিক। বেশি বাড়াবাড়ি করলে ভিডিও সবার মোবাইলে ছড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়া হয়। এ ঘটনা জানতে পেরে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ছাত্রীর পিতা।
ইতিহাস বিভাগের এক ছাত্রীকে প্রেমের প্রস্তাব দেয় একই বিভাগের এক ছাত্র। ছাত্রী প্রেমে রাজি না হলে তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। তার ফোন নম্বর ছড়িয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি ফেসবুকে ভুয়া আইডি খুলে সেখানেও লেখা হয় কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। প্রতিনিয়ত তার মোবাইল ও ফেসবুকে আসতে থাকে কুরুচিপূর্ণ এসএমএস। মানসিক যন্ত্রণায় মেয়েটির শিক্ষাজীবন থেকে ঝরে যায় একটি বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. আমজাদ আলী বার্তা৭১ডটকমকে বলেন, প্রতিনিয়ত এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে। শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তিকে ক্ষতিকর কাজে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, আমাদের কাছে অভিযোগ এলে চেষ্টা করি এর সুরাহা করে দিতে। অনেক সময়ই সমাধান করা যায় না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতার অভাব থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে বলে মনে করেন ড. আমজাদ। তিনি শিক্ষার্থীদের বিষয়ে পিতা-মাতা ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সচেতন ও ছোটবেলা থেকেই নৈতিক শিক্ষার বিষয়ে গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দেন।