ঢাকা, ৫ জুন: বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হতে যাওয়া আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ‘অর্থায়ন’কে ‘সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে চিহ্নিত করে নিজ দলের বাজেট ভাবনা উপস্থাপন করেছেন বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া।
মঙ্গলবার বিকেলে সোনারগাঁও হোটেলের বলরুমে ‘জাতীয় বাজেট: আমাদের ভাবনা’ শীর্ষক সুধী সমাবেশে দীর্ঘ লিখিত বক্তৃতা উপস্থাপন করেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সমাবেশে বিভিন্ন দেশের কূটনৈতিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীরা সহ ১৮ দলীয় জোট ও বিএনপির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বেশ কয়েকটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল এ অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করে, এছাড়া বিএনপির নিজস্ব ওয়েবসাইটেও সরাসরি সম্প্রচার করা হয় এটি।
বড় চ্যালেঞ্জ অর্থায়ন, সরকারের যোগ্যতার তুলনায় উচ্চাভিলাষী
লিখিত বক্তৃতায় বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন সামগ্রিক অর্থনীতির এমনি ‘বেহাল দশা’ হয়েছে যে আসন্ন অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের অর্থায়নের জন্য ‘‘রাজস্ব আদায় বাড়ানো ছাড়া অর্থমন্ত্রীর জন্য আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।’’ বেগম জিয়া মনে করেন ‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে’ সরকার যেভাবে ‘রাজনৈতিক অস্থিরতা’ বাড়াচ্ছে তাতে আগামী বাজেট বাস্তবায়নে অর্থায়নের এই প্রধান উৎসে প্রাক্কলন অনুযায়ী ২৫ ভাগ বৃদ্ধি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে।
আসন্ন বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ অর্থায়ন: বাজেট ভাবনা’য় বলা হয়, ‘‘২০১২-১৩ অর্থবছরের জন্য যে নতুন বাজেট পেশ করা হবে তার সব চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থায়ন। রাজস্ব আদায় বাড়ানো ছাড়া অর্থমন্ত্রীর জন্য আর কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না। প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায় নতুন বাজেটের জন্য অর্থমন্ত্রী প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করবেন ঘোষণা দিয়েছেন বলে জানা যায়। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের মাত্রা অর্জনের জন্য পরবর্তী অর্থবছরে ২৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি করতে হবে। কিন্তু মন্থর প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ ও উৎপাদনে স্থবিরতা এবং মূল্যস্ফীতির ফলে ২৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির প্রাক্কলন বাস্তবতা বিবর্জিত। তদুপরি, সরকার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে যেভাবে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের উপর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে তাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়বে।’’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যবসা বাণিজ্য এবং সামগ্রিক অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। ফলে রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাস্তবায়ন অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।’’
খাতবিহীন বরাদ্দ নির্বাচনে দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হবে: বিরোধীদলীয় নেত্রী বলেন, ‘‘২০১২-১৩ অর্থবছরে খাতওয়ারী বরাদ্দের বাইরে ১ হাজার ৫ শত ১৭ কোটি টাকা উন্নয়ন সহায়তার নামে বরাদ্দ রাখা হচ্ছে বলে জানা যায়। এই অর্থ সিটি কর্পোরেশন, জেলা, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়ন করা হবে মর্মে কাগজে-পত্রে উল্লেখ থাকলেও মূলত এ অর্থ দলীয় ব্যক্তিদের অর্থক্ষুধা মিটানোর জন্যই ব্যয় হবে। এর বাইরেও এক হাজার ৭ শত ৪০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দ হিসেবে রাখা হয়েছে বলে জানা যায়। সুনির্দিষ্ট প্রকল্প বহির্ভূত এ বরাদ্দ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক স্বার্থেই ব্যবহার করা হবে বলে আমাদের আশংকা। জনগণের করের অর্থ এভাবে নয়-ছয় করার অধিকার কারুর নেই।’’
সরকারী ব্যয় বাড়ানোর দায় টানতে হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে: বিএনপি চেয়ারপারসন অভিযোগ করেন ‘ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের চাহিদা পূরণ না করে সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির নীতি’র মাধ্যমে ‘ভবিষ্যত প্রজন্মকে জর্জরিত করা হয়েছে ভর্তুকি দায়ের চাপে।’ তিনি বলেন, ‘‘ভর্তুকির জন্যে ব্যয়িত অর্থের কত অংশ উৎপাদনের কাজে লেগেছে, আর কত অংশ সরকারের পেটোয়া গোষ্টির উদরপূর্ত্তি করেছে, সেটাই আজ জনগণের জিজ্ঞাসা। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক ক্রুটির চিত্রই ফুটে উঠেছে ভর্তুকির এই হিসাব থেকে। ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের চাহিদা পূরণ না করে সরকারী ব্যয় বৃদ্ধির নীতি চরম আত্মঘাতি। এর ফলে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি, ভেঙ্গে পড়েছে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ভারসাম্য। ভবিষ্যত প্রজন্মকে জর্জরিত করা হয়েছে ভর্তুকি দায়ের চাপে।’’
খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘ভর্তুকি ব্যয় বাড়ার ফলে ২০১১-১২ অর্থবছরে অতিমাত্রায় সরকারী ব্যয় বেড়েছে। … সব মিলিয়ে বর্তমান অর্থবছরে সরকারের ভর্তুকি ব্যয় দাঁড়াবে ৪০ হাজার কোটি টাকার উপর। এর মধ্যে বর্তমান অর্থবছরের বাজেট থেকে ২৯ হাজার কোটি টাকা দেয়া হবে এবং অবশিষ্ট ১১ হাজার কোটি টাকা আসন্ন অর্থবছরের বাজেটের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। বলগাহীন ভর্তুকি সরকারের অপরিনামদর্শিতা ও দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ।’’
কৃষিতে ভর্তুকি কমানো ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ হবে: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ‘‘এবার ধানের দাম কম হওয়াতে বিপাকে পড়েছেন এক কোটি প্রান্তিক বোরো চাষী। ’’ খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৫৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮০ টাকা, অর্থাৎ উৎপাদন খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। কিন্তু বাজারে এখন প্রতিমণ বোরো ধান ৪৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। লাভতো দূরের কথা কৃষকরা উৎপাদন খরচও উঠাতে পারছেনা। এতে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘‘সরকার ইতোমধ্যে ১০ লক্ষ টন ধান/চাল ক্রয়ের ঘোষণা দিয়েছে। ধানের ক্রয়মূল্য ১৮ টাকা কেজি আর চালের ক্রয়মূল্য ২৮ টাকা ধার্য করা হয়েছে । ইচ্ছাকৃতভাবে ক্ষুদ্র চাষীদের নিকট থেকে ধান ক্রয় না করে চাতাল মালিক, ফড়িয়া দালালদের নিকট থেকে সরকার ধান কিনছে। আর ফড়িয়া দালাল চাতাল মালিকরা কম দরে কৃষকদের নিকট থেকে ধান কিনে সরকারের নিকট বিক্রি করছে। ফলে চাষীরা দাম পায় না, সুবিধা ভোগ করে মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা – সঙ্গে যুক্ত হয় সরকারী দলের মাস্তান-চাঁদাবাজরা। তদপুরি অর্থমন্ত্রী স্পষ্ট বলেছেন, তিনি এবার কৃষিতে ভর্তুকি কমিয়ে দেবেন। যা হবে মড়ার উপর খাড়ার ঘা।’’
প্রয়োজনের তুলনায় নয়, সরকারের যোগ্যতার তুলনায় ‘উচ্চাভিলাষী’: সংবাদপত্র সূত্রের বরাত দিয়ে খালেদা জিয়া বলেন, ‘‘আগামী অর্থ বছরের জন্য সরকার একটি বিশাল ঘাটতি বাজেট উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। এ রকম বাজেট উপস্থাপিত হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন বৈদেশিক ঋণ ও সাহায্য প্রবাহ ক্ষীণ হয়ে আসছে। প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় শূণ্যের কোঠায়। প্রস্তাবিত বাজেটে ৫০ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ধরা হবে। বাজেটের আকার হবে ১ লক্ষ ৯০ হাজার কোটি টাকা।’’
তিনি বলেন, ‘‘আসছে বাজেটকে আমাদের প্রয়োজনের তুলনায় উচ্চাভিলাষী বলা যাবে না। তবে বাস্তবায়ন যোগ্যতা এবং প্রয়োজনীয় অর্থ যোগানে সক্ষমতার নিরিখে এ বাজেট অর্থহীন ও উচ্চাভিলাষী বৈকি। ২০১১-১২ উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৫৫ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে প্রথম ১০ মাসে। অবশিষ্ট ২ মাসে হবে অপচয় আর দুর্নীতি। এবারও আসছে বিপুল অংকের ঘাটতি বাজেট। অর্থ যোগান দেয়া হবে অপরিণামদর্শী ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে। ফলে অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা, নৈরাজ্য ও অস্থিরতা অবশ্যম্ভাবী।’’
বিরোধী দলের বাজেট প্রস্তাব গ্রহণ করছে না সরকার
বিরোধী দলের পক্ষ থেকে বিগত বছরগুলোতে উপস্থাপিত বাজেট ভাবনার নানা সুপারিশ গ্রহণ না করায় সরকারের সমালোচনা করে বিরোধী দলীয় নেত্রী বলেন, ‘‘বিগত দুটি অর্থবছরে আমাদের বাজেট-ভাবনা পেশ করতে গিয়ে আমরা বেশ কিছু সৃজনশীল প্রকল্পের প্রস্তাব রেখেছিলাম। এ প্রকল্পগুলো সরকার গ্রহণ করেনি। বরং, সরকারের অব্যবস্থাপনার ফলে জাতীয় অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। গত বছর বাজেট ভাবনা উপস্থাপনের সময় আমি সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যে আশংকা প্রকাশ করেছিলাম ও সরকারকে সতর্ক করেছিলাম, সরকার সে বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। আমাদের আশংকাগুলো সত্যে পরিণত হয়েছে।’’
তিনি আশংকা প্রকাশ করেন, ‘‘সরকার আজ জাতীয় অর্থনীতির এমন বেহাল দশা করেছে যে, ভবিষ্যতে সদিচ্ছায় উদ্বুদ্ধ যে কোনো সরকারের পক্ষে অর্থনীতিকে বেগবান করা দুরূহ হয়ে উঠবে।’’