রাজধানীর তোপখানা রোডের বাসায় নিশাদ বানু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে আসা খালেদা বানু জানিয়েছেন, ঘাতকরা বাসায় ঢুকেই আমার মেয়েকে হাত, পা চোখ, মুখ বেঁধে উপুড় করিয়ে শুইয়ে দেয়। আরেকজন এসে আমাকে বেঁধে ফেলে। এরপর ৩ ঘাতক আমার মেয়ে নিশাদের পিঠের ওপর লাফাতে থাকে। একপর্যায়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে দু’দিক থেকে দু’জন টান দেয়। এভাবে ৫ মিনিটের মধ্যেই আমার চোখের সামনে হত্যা করা হলো নিশাদকে। এ সময় ঘাতকরা হাই ভোল্টেজে টিভি ছেড়ে দেয়। তিনি জানান, দু’দিন ধরে একলা ঘরে লাশ দেখে দেখে কেবল কেঁদেছি। পানির জন্য অনেক চিৎকার করেছি। আশপাশের বাসার লোকজনের কথা আমি শুনতে পেলেও তারা কেউ আমার চিৎকার শুনেনি। কেবল আল্লহই আমাকে রক্ষা করেছে। জীবন বাঁচানোর জন্যে কেবল পানি পানি বলেই চিৎকার করছিলাম। অনেক কষ্টে বুধবার রাত আড়াইটায় বাঁধন খোলার পর একটু পানি খেয়ে জীবন ফিরে পেলাম। এরপর মেয়ের কাছে গিয়ে বাঁধন খুলি। ভাঙারি দোকানের সফিকুল, রাস্তার হকার এবং রিকশাওয়ালাদের ডাকি। কেউ আমাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। পাশের টিনসেট ঘরের আলমকে জানালা দিয়ে বলেছি- আমার মেয়েকে ঘাতকরা মেরে ফেলেছে। আমিও মরে যাচ্ছি। লাশে পচন ধরেছে। একটু থানায় খবর দে। আলম জানায়, তার কাছে থানার টেলিফোন নম্বর নেই। সকালে আলমকে আবার অনুরোধ করি- পাশের মেসের ছেলেদের খবর দে। পাশের লন্ড্রিতে গিয়ে আবুল ড্রাইভারকে আমার ভাইকে খবর দিতে বল। মেসের ছেলেরা থানা পুলিশকে খবর দেয়। পরে মেসের একটি ছেলে আসে। এরপর পুলিশ এবং আশপাশের লোকজন আসে। তিনি জানান, ৩ কিলারই এসেছিল খালি গায়ে। তাদের হাতে ছিল ছোরা এবং বড় কেঁচি। পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট। একজন লম্বা গড়নের। তার মাথার সামনের চুলগুলো কুকড়ানো। বাকি দু’জন মাঝারি গড়নের। তাদের কেউই মুখোশধারী ছিল না। দেখলে চিনতে পারব। বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। ৩ জনের চেহারাই কালো এবং বিকট ধরনেই। দেখেই ভয় পেয়েছিলাম। খালেদা বানু জানান, তারা আমার গলাতেও ছুরি বসিয়েছিল। গলায় ছুরি লাগিয়ে বলেছিল, একা একা অনেক সুখ করেছিস। আর না। আমার ওপর আল্লার অশেষ মেহেরবানী থাকায় হয়তো তারা ছুরি চালাতে গিয়ে চালাতে পারেনি। যাওয়ার সময় তারা আমাকে তোশক দিয়ে ডেকে রেখে যায়। ভেবেছিল হাতপা বেঁধে তোশক দিয়ে ডেকে রেখে গেলে না খেয়ে এমনিতেই মারা যাব। আমাকে শাড়ী এবং ওড়না দিয়ে প্রায় ১০০ বাঁধ দেয়। আমি যাতে কোথাও যোগাযোগ করতে না পারি সে জন্য ঘাতকরা আমার মোবাইল ফোন নিয়ে যায়। টেলিফোন সেট বিকল করে দিয়ে যায়। নোটবুকটিও নিয়ে যায়। মঙ্গলবার রাত ৮টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত খুনিরা বাসায় অবস্থান করে বাসার সব কিছু তছনছ করে। আগের দিন ৭০০ টাকার ফল কিনেছিলাম। তারা সবগুলো খেয়েছে।
এদিকে হত্যাকাণ্ডের পুলিশি তদন্তে ঢিলেঢালা ভাব। তদন্তের অগ্রগতি জানাচ্ছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। একজন অপরজনের ওপর দায়িত্ব চাপানোর চেষ্টা করছেন। অপরদিকে নিহত নিশাদের মা বৃদ্ধা খালেদা বানু তার দীর্ঘদিনের ভাড়াটিয়া মনিরের ২ ছেলে সেলিম, সাইফুল এবং অজ্ঞাত ৩ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেছেন। গোয়েন্দা পুলিশ সন্দেহজনকভাবে সেলিম ও সাইফুলকে শুক্রবার আটক করলেও এখনও গ্রেপ্তার দেখায়নি। খালেদা বানুর বাসার নিরাপত্তায় সার্বক্ষণিক ২জন পুলিশ সদস্য অবস্থান করছেন। ওদিকে খালেদা বানুর জোর দাবি- সাইফুল এবং সেলিম ভাড়াটে কিলার দিয়ে হত্যা করেছে নিশাদকে। খালেদা বানুর প্রশ্ন- এখন আমার কি হবে? নিশাদই আমার শেষ অবলম্বন ছিল। তাকে নিয়েই বাসায় থাকতাম। আমি এখন কাকে নিয়ে থাকব? এ বাড়ি ছেড়েও কোথাও যেতে পারব না। এ বাড়ি ছেড়ে গেলে এ বাড়িটি তারা দখল করে নেবে। বিলাপ করতে করতে খালেদা জানান, খুনিদের কঠিন শাস্তি চাই। তবে মনে হয় না তাদের শাস্তি হবে। ছোট মেয়েকে হত্যা প্রচেষ্টায় দায়েরকৃত মামলায় মনির ৭ দিনেই জামিন পেয়ে যায়। ৪-৫ মাসেও সাগর-রুনরি খুনিদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি জানান, ২০ বছরে ধরেই দ্বন্দ্ব চলছিল মনিরের সঙ্গে। মাস দুয়েক আগে মনির মারা গেলেও তার ছেলেরা এখন আমার পিছু নিয়েছে। এর আগে মনির আমার ছোট মেয়ে জেবা সানজিদাকে বাসার কাজের মেয়ে আছিয়ার মাধ্যমে পানিয়ে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছিল। তখন আছিয়াকে লোভ দেখানো হয়েছিল সানজিদাকে হত্যার বিনিময়ে নগদ ২ হাজার টাকা দেয়া হবে। ভাল বিয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখানো হয়েছিল। সানজিদাকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করায় সে প্রাণে বেঁচে যায়। এ ঘটনায় মামলা করি। মনির ৭ দিন এবং আছিয়া ৫ মাস জেল খাটে। খালেদা বানু জানান, ১৯৮৩ সালে মনির আমার কাছ থেকে সাড়ে জমির ওপর নির্মিত ঘর ভাড়া নিলেও ভাড়া পরিশোধ করেনি। তার বিরুদ্ধে মামলা করি। মামলার রায় অনুযায়ী- ১৯৯২ সাল থেকে তিনি আদালতের মাধ্যমে প্রতিমাসে ৪ হাজার টাকা ভড়া দেয়ার কথা। ওই ভাড়ার টাকাও আমি পাচ্ছি না। মনির আদালতে ভাড়ার টাকা জমা দিলেও আমার স্বাক্ষর জাল করে সে ভাড়া তুলে নিচ্ছিল। খালেদা বানুর ভাই আবুল মনসুর জানান, সম্পত্তির লোভে মনিরের ছেলেরাই নিশাদকে হত্যা করেছে। ডাকাতি করতে আসলে তারা জমির দলিলপত্র নিয়ে যাবে কেন? আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর হেফাজতে সেলিম এবং সাইফুলকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সবকিছু বেরিয়ে আসবে।
পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিনাম নুরুল ইসলাম জানান, বিষয়টি নিয়ে বলার মতো কোন অগ্রগতি হয়নি। শাহবাগ থানার ওসি সিরাজুল ইসলাম জানান, মামলাটি ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই। একই থানার ওসি (তদন্ত) পল্লব কিশোর শীল জানান, জমি সংক্রান্ত বিরোধের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়েই তদন্ত চলছে। এ ক্ষেত্রে মনিরের ছেলেরা অথবা বৃদ্ধার আত্মীয়রা জড়িত থাকতে পারে। এখনও ফাইনাল কিছু পাওয়া যায়নি। আপনি তদন্তকারী কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তিনি ভাল বলতে পারবেন। বারবার যোগাযোগ করেও তদন্তকারী কর্মকর্তা নূরুল হককে পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার শহিদুল্লাহ জানান, আমি গতকাল থেকেই ছুটিতে আছি। ঢাকার বাইরে অবস্থান করছি। এ বিষয়ে আমার কাছে কোন তথ্য নেই। আমি এডিসি (পিআর)-এর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। এডিসি (পিআর) মাসুদুর রহমানকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। অফিসে গিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি। ডিবি’র পরিদর্শক ফজলুর রহমান জানান, মামলা ডিবিতে হস্তান্তর হয়নি। মামলা তদন্ত করছে থানা পুলিশ। আমরা কেবল আটককৃত ২ জনকে জিজ্ঞাসাববাদ করা হচ্ছে। এখনও তেমন কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। সন্দেহের তীর আটককৃতদের বিরুদ্ধে বেশি। অন্যদিকেও আমাদের সন্দেহ রয়েছে। প্রয়োজন হলে আটককৃতদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করে রিমান্ড চাওয়া হবে।