নিজের সম্পর্কে হাই কোর্ট বিভাগের এক বিচারপতির মন্তব্যে প্রকাশ করলেও ওই বিচারককে অপসারণের প্রস্তাব প্রত্যাহারের জন্য সংসদ সদস্যদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন স্পিকার আবদুল হামিদ।
বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরীর এক মন্তব্যের ফলে সৃষ্ট উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে সোমবার সংসদ অধিবেশনের শুরুতেই দেওয়া বক্তব্য স্পিকার আশা করছেন, এর মধ্য দিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটবে।
সংসদ সদস্যদের ক্ষোভের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আবদুল হামিদ আশা করেছেন, ওই বিচারকের অনাকাঙ্ক্ষিত বক্তব্যের বিষয়ে প্রধান বিচারপতিই পদক্ষেপ নেবেন। ওই পদক্ষেপে সংসদেরও সায় থাকবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
একজন বিচারকের মন্তব্যে বিচার বিভাগের সঙ্গে সংসদ ও শাসন বিভাগের মুখোমুখি অবস্থানের মতো পরিস্থিতি তৈরি হবে না বলে দৃঢ় আশা প্রকাশ করে স্পিকার বলেছেন, “আমাদের সকলকে মনে রাখতে হবে বর্তমানে এদেশ পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ। আবারো বলছি- বাংলাদেশ।”
গত ২৯ মে সংসদে দেওয়া স্পিকারের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে এই বিতর্কের সূত্রপাত।
সুপ্রিম কোর্টের জমি ছেড়ে দিতে সড়ক ও জনপথ বিভাগকে দেওয়া উচ্চ আদালতের একটি আদেশ পুনর্বিবেচনার অনুরোধ জানিয়ে স্পিকার সেদিন বলেছিলেন, আদালতের রায়ে ক্ষুব্ধ হলে জনগণ বিচার বিভাগের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে পারে।
স্পিকারের ওই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল অপরাধ বলে ৫ জুন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী বললে সেদিনই সংসদে তুমুল উত্তেজনা সৃষ্টি হয়।
ওই বিচারপতিকে অপসারণে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি তুলে মহাজোটের সংসদ সদস্যরা বলেন, অন্যথায় সংসদই ওই বিচারককে অভিশংসন করার উদ্যোগ নেবে।
এরপর ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী সংসদে জানান, এই বিতর্কের বিষয়ে স্পিকার রুলিং দেবেন। সোমবার ওই রুলিং দেন আবদুল হামিদ। এই সময় সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী অধিবেশণ কক্ষে ছিলেন না।
স্পিকার বলেন, “হাই কোর্টের একজন মাননীয় বিচারপতি সংবিধানের ৭৮(১) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে সংসদ সম্পর্কে, আমার সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে।
“প্রথমেই তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন, এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তার বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।”
বিচারকের বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো সংসদ সদস্যদের প্রতি স্পিকার বলেন, “একজন ব্যক্তিবিশেষের আচরণ দিয়ে আমরা পুরো বিচার বিভাগকে মূল্যায়ন করতে পারি না। আপনারা সবাই সিদ্ধান্ত নিলে আমার জন্য তা বাধ্যবাধকতা হয়ে যায়।
“সার্বিক বিবেচনায় যেহেতু এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ সমীচীন হবে বলে আমি মনে করি না, তাই আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করব, সংসদে আপনাদের উত্থাপিত প্রস্তাবটি আপনারা আমার সঙ্গে একমত হয়ে প্রত্যাহার করবেন।”
রাষ্ট্রের মূল তিনটি অঙ্গের মধ্যে পারস্পরিক আস্থার সম্পর্ক ধরে রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “পারস্পরিক এই সুসম্পর্কের কারণেই অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এদেশ আজ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
“দেশ ও জাতির কল্যাণে এ সম্পর্ক আরো অটুট হোক, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা,” বলেন তিনি।
স্পিকার বলেন, “আমি আশা করব, আদালতের এই ধরনের আচরণে কী করণীয় থাকতে পারে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সে বিষয়টি ভেবে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন তাতে আমাদের সমর্থন থাকবে। এর ফলে এ ধরনের ঘটনার পূনরাবৃত্তি রোধ করা হয়ত সম্ভব হবে।”
“আশা করি, আমার এই বক্তব্য প্রদানের মধ্য দিয়ে এ আলোচনার অবসান হবে,” বক্তব্যের ইতি এভাবেই টেনেছেন আবদুল হামিদ।
নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা
রুলিংয়ে ২৯ মে সংসদে দেওয়া বক্তব্যের প্রেক্ষাপট এবং তার ব্যাখ্যা তুলে ধরে আবদুল হামিদ বলেন, “ওই দিন সংসদ সদস্য মইন উদ্দীন খান বাদল আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বক্তব্য রাখলে আমি হাস্যচ্ছলে বলেছি, আমার স্পিকারশিপের মেয়াদ শেষ হলে আমাকে আবার কালো কোট পরে কোর্টে যেতে হবে। সুতরাং হিসাব করে কথা বলতে হয়। আবার কোন সমস্যায় পড়ে যাই। মামলা পরিচালনা করতে গিয়ে রিলিফ নাও পেতে পারি।”
“এরপর গণমানুষের কাছে সবার জবাবদিহিতার বিষয়টি তুলে ধরতে গিয়ে বলেছিলাম, সংসদে সংসদ-সদস্যরা যে আইনগুলো পাস করেন সেগুলো যদি জনগণের বিরুদ্ধে যায়, তাহলে শেষ পর্যন্ত জনগণ আমাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে। কোর্টের বিচারে যদি দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ হয়, তাহলে বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে মানুষ একদিন হয়ত রুখে দাঁড়াতে পারে,” বলেন তিনি।
স্পিকার বলেন, “আত্মঅহমিকা বিসর্জন দিয়ে দেশ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার কথা বলেছি। কোনো আদালত বা কোনো মামলা বা কোনো বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে কোনো কথা বলা হয়নি। মূলত রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কাজে কোনো ব্যত্যয় ঘটলে কী হতে পারে, তারই একটা ধারণার কথা বলেছি।”
তিনি বলেন, “আসলে ওই দিন সংসদ সদস্য স্পিকারের মাধ্যমে আইনমন্ত্রীর কাছে সড়ক ভবন সরিয়ে নেওয়ার জন্য সময় প্রদানের বিষয়টি উত্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আইনমন্ত্রী তখন সংসদে উপস্থিত না থাকায় আমি বিষয়টি সংসদকে অবহিত করি এবং বলি ‘থাকলে হয়তো তিনি ব্যাপারটা দেখতেন’। এটুকুই বলেছি।”
“আইনমন্ত্রীকে সড়ক ভবনের বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি- এ ধরনের কোনো কথা বলিনি,” বলেন স্পিকার।
বিচারকের মন্তব্যের প্রতিক্রিয়া
সংসদ সম্পর্কে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর মন্তব্য অসৌজন্যমূলক ও ব্যক্তিগত আক্রমণ প্রসূত বলে অভিহিত করেছেন স্পিকার। তবে এই নিয়ে পুরো বিচার বিভাগকে জড়ানো ঠিক হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
রুলিংয়ে আবদুল হামিদ বলেন, “আমার সম্পর্কে যে সব মন্তব্য করেছেন (বিচারপতি), তা কোনো বিবেকবান মানুষ উচ্চারণ করতে পারেন কি না, আমার সন্দেহ রয়েছে। প্রথমেই তিনি বলেছেন, আমার বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। আমার উপরোক্ত কথাগুলো কোনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে তা আমার বোধগম্য নয়।
“রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ উত্থাপনের আগে রাষ্ট্রদ্রোহিতা কী, কোন কাজ রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়ে, রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিষয়টি কে নির্ধারণ করতে পারেন- এসব বিষয় গভীরভাবে চিন্তা করলে বিজ্ঞ বিচারপতি তার বিজ্ঞতার পরিচয় দিতেন।”
বিচার বিভাগ সম্পর্কে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্য করায় আইনজীবী হিসেবে স্পিকারের সনদ থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন।
পাশাপাশি সংবিধান নিয়ে স্পিকারের ‘জ্ঞান’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেছিলেন, “যিনি তার পদের মর্যাদা রক্ষা করতে পারেন না, তার এই পদে থাকার কোনো যোগ্যতা নেই।”
এর প্রতিক্রিয়ায় আবদুল হামিদ বলেন, “আমার জ্ঞান, মেধা, যোগ্যতা ও আইনজীবী হিসেবে আমার সনদ নিয়ে কটাক্ষ করা হয়েছে। আমি প্রায়শই বলি, আমি কম লেখাপড়া জানা মানুষ।”
৩৭ বছরের পেশাগত জীবনে সাবেক প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ও এ বি এম খায়রুল হক এবং বর্তমান প্রধান বিচারপতির আদালতে আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথাও তুলে ধরেন তিনি।
“বড় বড় বই হয়ত পড়িনি, কিন্তু সাধারণ মানুষের মনের কথাটি বিগত ৫৪ বছর ধরে পড়ে আসছি। অক্ষর জ্ঞানহীন মানুষের কাছ থেকেও আমি সারাজীবন অনেক কিছু শিখেছি,” বলেন বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আবদুল হামিদ।
দ্বিতীয় বার স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব পালনরত আবদুল হামিদ বলেন, “সরকারি দল, বিরোধী দল ও অন্যান্য দল আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে স্পিকার নির্বাচিত করেছেন। আমার জ্ঞান, যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তা সংসদের সব সদস্যের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।”
“এ ধরনের উক্তি করার আগে বিজ্ঞ বিচারক আরো গভীরভাবে চিন্তা করলে ভালো করতেন। বিজ্ঞ বিচারক আরো অনেক বিষয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন, যা আমি এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি না,” বলেন তিনি।
স্পিকার বলেন, “আমাদের প্রত্যাশা ছিল, বিচারপতি সমস্ত বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করবেন এবং মাত্রা অতিক্রমকারী বক্তব্য পরিহারে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি।”