চারটি শর্তের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ছাড়া বর্তমান অবস্থায় বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাংলাদেশের বহুল আলোচিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনার কোন সম্ভাবনা নেই’ বলে জানিয়েছেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক জার্নাল এফেয়ার্স ম্যানেজার এঞ্জেলা ওয়াকার। গতকাল কর্মদিবসের শেষ ঘণ্টায় ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তর থেকে তার মুঠোফোনে এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন- এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের সুস্পষ্ট অবস্থান হলো, সরকার এখনও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে ইতিপূর্বে উল্লিখিত প্রধান প্রধান উদ্বেগগুলোর (মেজর কনসার্নস) পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে আন্তরিক পদক্ষেপ নিয়েছে বলে ব্যাংকের কাছে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত না হওয়ায় এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক এখনও কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বা অনুরোধ না পাওয়ায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ঋণচুক্তি বাতিল সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত এখনও পূর্ণাঙ্গরূপে বহাল আছে। এঞ্জেলা বলেন, গত মাসে জাইকা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক প্রধানের সাক্ষাতের অব্যবহিত আগে ও পরে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় বিশ্বব্যাংক আশা প্রকাশ করেছিল- পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনার বিষয়টি ইতিবাচক ভাবে দেখার একটি সুযোগ তৈরি হবে এবং এরপর থেকে এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারকে ইতিপূর্বে দেয়া সুস্পষ্ট চারটি শর্ত পূরণের লক্ষ্যে সরকার গৃহীত পদক্ষেপসমূহ বিশ্বব্যাংক অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার উপরিউক্ত শর্তসমূহ পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেয়নি এবং শর্ত পূরণে সরকারের সম্মতি বা সরকার কর্তৃক ইতিমধ্যে গৃহীত পদক্ষেপসমূহের অগ্রগতি সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বব্যাংককে কিছুই জানায়নি, যার ফলে নিঃসন্দেহে এখনই ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনার কোন সুযোগ তৈরি হয়নি। এমনকি বাংলাদেশ সরকার পূর্ণাঙ্গরূপে সবগুলো শর্ত বাস্তবায়ন না করে বর্তমান অবস্থানে অটল থাকলে অদূর ভবিষ্যতেও এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য জাইকা ও এডিবি’র সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের সমপ্রতি নবায়নকৃত ঋণচুক্তির মেয়াদ আগামী ৩১শে আগস্ট শেষ হতে যাচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বিতর্ক নিরসনে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমের ওপর সমপ্রতি সংবাদ মাধ্যমে ক্রমাগত নানামুখী সংবাদ প্রকাশের পর এ বিষয়ে ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দপ্তরে যোগাযোগ করা হলে গতকাল বিকালে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু বিষয়ে তার সর্বশেষ অবস্থান ব্যাখ্যায় উপরিউক্ত মন্তব্য করে।
বিশ্বব্যাংকের শর্ত পূরণে সমপ্রতি বাংলাদেশ সরকার গৃহীত বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এঞ্জেলা ওয়াকার তা স্বীকার করে বলেন, কিন্তু মেজর কনসার্নসগুলোর পূর্ণাঙ্গ ও গ্রহণযোগ্য সমাধানে সরকারের অনীহা ব্যাংকের নিকট এখনও একটি উদ্বেগের বিষয়। এ সময় মেজর কনসার্নস বলতে কি কি বিষয়কে বোঝানো হচ্ছে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, এ বিষয়ে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে প্রশ্নোত্তর ধাঁচে বেশ কিছু বিষয়ের সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। যে কোন নাগরিক চাইলে তা সরকারের নেয়া পদক্ষেপসমূহের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
এদিকে গতকাল দিনভর নিউ ইয়র্কের মিডিয়া মহলে জোর গুঞ্জন ওঠে যে, পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ে বিশ্বব্যাংক তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে সম্মত হয়েছে এবং এ বিষয়ে ব্যাংকের সিদ্ধান্ত মার্কিন সময় আজ সকালে ব্যাংকের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে এঞ্জেলা ওয়াকার বলেন, আমার কাছে এরকম কোন তথ্য নেই, ঢাকার সঙ্গে আজ সকালেও কনফারেন্স কলে কথা হয়েছে। তাছাড়া, আগামীকাল আমার জন্মদিন উপলক্ষে ছুটিতে থাকবো, তাই কালই কিছু জানাতে পারবো না, তবে এ বিষয়ে এটুকু বলতে পারি আগামীকাল বা আগামী সপ্তাহের মধ্যেই বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তে বড় কোন পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না।
বিশ্বব্যাংকের অপর একটি সূত্র জানায়, অতীতে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বাতিলকৃত ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনার উদাহরণ খুব কম হলেও, পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে সমপ্রতি বাংলাদেশ সরকারের বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপের ফলে এ প্রকল্পের পুনর্বিবেচনার সম্ভাবনা অনেক উজ্জ্বল ছিল। এর আগেও বলা হয়েছিল টেকনিক্যালি এটা অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু প্রকল্পের অধিকতর স্বচ্ছতার স্বার্থে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক বেঁধে দেয়া সব শর্ত পূরণে সরকারের আংশিক উদ্যোগ এবং এখনও প্রধান প্রধান শর্তগুলো পূরণে সরকারের গুরুত্বের অভাব, এ প্রকল্পে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানকে বিশ্বব্যাংকের কাছে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ফলে শর্তপূরণের দাবিকে পাশ কাটিয়ে বেশ কিছু প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মাধ্যমে বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সরকারি প্রচেষ্টা শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হতে পারে। উক্ত সূত্রের মতে, বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের বিষয়বস্তু আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে প্রকাশ না করায় এবং স্বচ্ছতার স্বার্থে শর্তপূরণের মতো এমন সহজ পথে না গিয়ে সরকার এ বিষয়ে পরস্পরবিরোধী মন্তব্য ও পন্থায় অগ্রসর হওয়ায়, জনমনে সরকারেরর উচ্চ পর্যায় থেকে এ বিষয়ক দুর্নীতিতে জড়িত থাকার আশঙ্কার বিষয়টি দৃঢ় হতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য, এ প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনার সময় সূত্রটির বেশ কয়েকটি সম্পূরক প্রশ্নে মনে হয়েছে যে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল বিষয়ে জনগণের কাছে সরকারের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য কি হয় তা জানতে ব্যাংকের একটি বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। অতীতে বেশ কয়েকবার বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী প্রস্তাবিত পদ্মা সেতু বিষয়ক প্রেস কনফারেন্সগুলো নিয়ে সূত্রটির ব্যাপক আগ্রহের তাৎপর্যপূর্ণভাবে লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্বব্যাংকের ওই সূত্রটির মতে, পদ্মা সেতু হবে, তবে প্রকাশ্যে না হলেও, গোপনে সব শর্ত মেনেই সরকারকে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সমঝোতায় আসতে হবে।