প্রয়াত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শেষকৃত্য বৃহস্পতিবার দুপুরে কলকাতার কেওড়াতলা মহাশ্মশানে অনুষ্ঠিত হবে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র শৌভিক গঙ্গোপাধ্যায় ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যমকে একথা জানান।
শৌভিক জানান, তার পিতার শেষকৃত্য হবে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। পরিবারের সদস্যদের ইচ্ছানুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এর আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল আনুষ্ঠানিকতা শেষে লেখকের অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী তার মরদেহ কোনো একটি মেডিকেল কলেজে দান করা হবে। তবে পুত্র শৌভিক তাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। এ কারণে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মরদেহ দাহ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মরদেহ এখন কলকাতার পিস হ্যাভেনে লাশ ঘরে রাখা হয়েছে।
শেষকৃত্যের আগে শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ তার দীর্ঘদিনের কর্মক্ষেত্র আনন্দবাজার কার্যালয়ে নেয়া হবে। এছাড়া রবীন্দ্র সদন ও সাহিত্য একাডেমিতে তাকে শ্রদ্ধা জানানো হবে। এরপর কেওড়াতলা মহাশ্মশানের দিকে অন্তিমযাত্রা হবে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই কথাসাহিত্যিকের।
তিনি সোমবার দিবাগত রাত ২টায় তিনি দক্ষিণ কলকাতার বাসভবনে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরলোকগমন করেন।
সাহিত্য, কবিতা, গল্প, উপন্যাসসহ লেখার সবক্ষেত্রে বিচরণ ছিল শক্তিধর লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে তিনি ছিলেন সবার কাছে প্রিয়। একাধারে কবি, উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক ও কলাম লেখক সুনীলের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশের বর্তমান মাদারীপুর জেলায়। মাত্র চার বছর বয়সেই তিনি পরিবারের সঙ্গে কলকাতা চলে যান। তবে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এবং ব্যক্তিগত সফরে অসংখ্যবার তিনি বাংলাদেশে এসেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল তরুণ সুনীলকে। ফলে রক্তঝরা সেই দিনগুলোতে তিনি শরণার্থী শিবির ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেন।
সুনীলের ‘প্রথম প্রেম’ ছিল কবিতা। পরে তিনি গদ্যে মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার ঠিক আগের বছর তিনি কবিতার পত্রিকা কৃত্তিবাসের সম্পাদনা শুরু করেন, যা পরে পরিণত হয় তখনকার তরুণ লেখকদের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে।
সুনীলের লেখা ‘নিখিলেশ’ আর ‘নীরা’ সিরিজের কবিতাগুলো তরুণদের মুখে মুখে ছিল বহুদিন।
১৯৫৮ সালে প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পর ১৯৬৬ সালে পাঠকের হাতে পৌঁছায় সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’।
নীললোহিত, সনাতন পাঠক, নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে সুনীল লিখে গেছেন ভ্রমণ কাহিনী, গোয়েন্দা গল্প, কখনো বা শিশুতোষ সাহিত্য। ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’, ‘হঠা নীরার জন্য’, ‘অর্ধেক জীবন’, ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘মনের মানুষ’ -এর মতো বইগুলো যেমন পাঠকপ্রিয় হয়েছে, তেমনি সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছে ব্যাপকভাবে।
সুনীলের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ উপন্যাসকে চলচ্চিত্রের রূপ দিয়েছেন অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায়। আর লালনকে নিয়ে লেখা সুনীলের ‘মনের মানুষ’-এর চলচ্চিত্রায়ন করেছেন গৌতম ঘোষ।
সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৭২ ও ১৯৮৯ সালে দুই দফা আনন্দ পুরস্কার, ১৯৮৫ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, ২০১১ সালে হিন্দু লিটারেরি পুরস্কারসহ জীবনভর বিভিন্ন সম্মাননা লাভ করেছেন তিনি।
জীবিকার জন্য সুনীল পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। ভারতের সর্বাধিক পঠিত বাংলা দৈনিক আনন্দবাজারে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। দায়িত্ব পালন করেছেন ভারতের জাতীয় সাহিত্যপ্রতিষ্ঠান সাহিত্য আকাডেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশু-কিশোর আকাডেমির সভাপতি হিসেবেও।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার বরেণ্য এই কথাসাহিত্যিককে ২০০২ সালে সাম্মানিক পদ ‘কলকাতার শেরিফ’ হিসাবে নিয়োগ দেয়।
দুই শতাধিক গ্রন্থের রচয়িতা সুনীল ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন স্বাতী বন্দোপাধ্যায়কে। তাদের একমাত্র সন্তান সৌভিক গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ‘নীল লোহিত’ সনাতন পাঠক ও ‘নীল উপাধ্যায়’ ছদ্মনামেও লিখেছেন। শিশু সাহিত্যে তিনি ‘কাকাবাবু সন্তু’ নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা।