বার্তা৭১ ডটকমঃ বিয়ে বস্তুটির ওপর আমার আর বিশেষ ভরসা নেই। ওটার মধ্যে দিয়ে যেতে গিয়ে আর কিছু হোক না হোক আমার ইমোশনের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এক্কেবারে খোলামেলা পরিবেশে আমি তৈরি হয়েছি। আমার বাবা পাহাড় আর ছবি তোলার নেশায় বছরের অর্ধেক সময় বাড়িতেই থাকতেন না। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই মা-ও নিজের পৃথিবী খুঁজে নিয়েছিলেন। বাড়িতে তিনটে মানুষ, আমরা ঠিক তিনরকম ভাবে জীবন কাটিয়েছি, আজ-ও তাই। তবে দুর্গা
পুজোর ঠাকুর দেখার ভিড় থেকে রাত ঘুমের বালিশে আমি বাবাকে অনেক খুঁজেছি, কখনও বা মা-কে।
বই, গান, নাটক এসবের মাঝে বড় হওয়া আমি আসলে এই খোঁজার রাস্তায় সঙ্গ খুঁজতাম, ভাললাগা চাইতাম, নিরাপত্তার আশ্বাস আমায় জাগিয়ে রাখত। এই একলা মন নিয়েই স্কুল থেকে কলেজে নানান পুরুষের হাত ধরেছি, শেয়ার করেছি বাদামের ঠোঙা। আমার বান্ধবীর চেয়ে বন্ধুই হত বেশি, আজ-ও তাই। এটা জানি না কেন! কিন্তু কাউকেই মনের ভিতরে জায়গা দিতে পারতাম না। ঘুরতাম কেবলই, কোথাও ধরা দেওয়া বা ঘিরে ধরার ক্ষেত্র তৈরি হত না। মা খুব চিন্তায় পড়েছিলেন। কলেজ শেষ হতে চলা এই উড়ু উড়ু মেয়ের মনকে বেঁধে দিতে চেয়েছিলেন। আসলে নিজেও তো কোনও সময় দিতে পারতেন না, তাই হয়ত ভেবেছিলেন বিয়ে দিয়ে মেয়েকে স্থিতি দেবেন। আমার সব ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের কথাও মা জানতেন, আর সেই কারণেই টের পেয়েছিলেন আমার অন্তহীন খুঁজতে চাওয়ার উচ্ছ্বাসকে।
বিয়ে হল আমার, থার্ড ইয়ার শেষ করেই। এক সৌম্যকান্তি অভিজাত পুরুষের বাড়িতে আমার ঠাঁই হল। কিন্তু ক্রমশ আমি নিজেকে ফুরিয়ে দিতে বাধ্য হলাম। বই-এর বদলে শাশুড়ি আমার হাতে লক্ষীর পাঁচালি ধরালেন, ও বাড়ির বউরা কেউ গান শোনে না! আমার গান শোনা বন্ধ হল। মেনসট্রুয়াল সাইকেলের সময় আমায় এক ঘরে করে রাখা হত, নিয়ম মেনে শীতের রাতেও জোর করে ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে মাথায় সার্ফ ঢেলে মাথা ঘোষে আমার শরীরের এই সামান্য ঘটনাকে বাড়িসুদ্ধু লোকের কাছে অকারণ মেলে ধরা হত। আর সব শেষে আমার বরের বন্ধুর সঙ্গে বাড়ির ড্রয়িংরুমে গল্প করায় বরের পিটুনি খেতে হল! তিন বছরের মাথায় চলে এলাম। আমার বেরিযে আসাটা অনেক সহজ ছিল কারণ হ্যান্ডসম বড় লোক বরের প্রতি তখন কোনও ধরনের মানসিক নির্ভরতা আমার ছিল না। ভাগ্যিস হয়নি! নয়ত অধিকাংশ মেয়ের মতো আমিও মানিয়ে গুছিয়ে থেকে যেতাম।
ওখান থেকে চলে আসার পর-ও নানান ভাবে লোক পাঠিয়ে কলেজের পথে আমার দিকে অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে, আমার আপনভোলা বাবাকে বিরক্ত করে ওরা ওদের বর্বরতার জানান দিয়ে বেড়াত। ডিভোর্সের পর আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গেলাম বন্ধু-বান্ধব, পার্টি, বই, নাটক আর চাকরিতে।
কুড়ি থেকে পঞ্চাশ এই বয়েসের অনেক পুরষ আমার বন্ধু। হঠাৎ যে কারোর সঙ্গে যে কোনওদিন ওয়াইন বা কফির চুমুকে আমি সন্ধে নামাতে পারি। কিন্তু এরা কেউই আমার প্রেমিক নয়। মানে এরকমও হয়, আজ যার সঙ্গে সারাটাদিন কাটালাম ছ মাস হয়ত তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই আমার থাকবে না। ইনফ্যাক্ট সেই রাতে সে ঠিক মতো বাড়ি ফিরল কি না সে খোঁজ-ও আমি কোনওদিন রাখতে চাই না। এভাবেই নিজের ছন্দে ফিরেছি আমি, এভাবেই আমার জীবন নানান বন্ধুর উষ্ণতায় ভরে আছে। তাদের কারোর সঙ্গেই এখনও শরীরে মিশিনি আমি। আজ যদি তাদের মধ্যে থেকেই কেউ সোজাসুজি আমায় শরীরি খেলায় ডাক দেয় আর ভিতর থেকে যদি আমি সাড়া পাই, তবে যেতে পারি, দিতে পারি লম্বা ছুট! কিন্তু এক্ষেত্রে দুটো বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ, এক আমার চাওয়া আর তার সোজাসুজি বলা। কোনও ন্যাকা, মিনমিনে লুকোছাপা করা পুরুষ আমার পছন্দ নয়।
বিশেষ বন্ধুও এসেছে আমার জীবনে। যার সঙ্গে একটু প্রেম, অনেক শপিং, দুদিনের আউটিং-এ শরীর নয়, মন মেতেছে আমার। ওর কাছে প্রথম দিনই আমি নিজের সব কথা বলে রেখেছি। ও অনেক স্পেস দেয় আমায়। কিন্তু বিয়ের কথা এখনও ভাবি না। আমি ভাবতে পারি না। প্রেম, বিয়ে আলাদা করে তেমনভাবে বোধহয় আর চাই না। বন্দী হতে চাই না কোনও স্ট্রাকচার-এ। এই জায়গায় থামল অয়ন্তিকা, রঙে রঙে মরীচিকা আঁকে ওর মন। খানিক স্তব্ধ আমি, ওর জন্যে মনে এল শ্রীজাত-র ‘প্রেম’ কবিতার শেষটুকু-
‘তার চোখের নীচে কালির মতো একফালি যে বাঁচা
সেই বাঁচারও নিয়ম তো আছেই। পারলে শিখে নিও
ট্রামের গা বেয়ে উঠেছে, দ্যাখো, বনেদি পরগাছা —
তার কিছুটা ভুল, আর কিছুটা জীবনানন্দিয়…