দুই দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো গত মাসে অনুষ্ঠিত সামরিক অংশীদারিত্বের সংলাপের পর আগামীকাল শনিবার বাংলাদেশ সফরে আসছেন আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন। নয় বছরের মধ্যে প্রথম আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারির ঢাকা সফরকালে এ অঞ্চলে দেশটির ‘চীন ঠেকানো’ নীতির অনুকূলে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন যুক্ত হতে যাচ্ছে। দুই দেশ একটি যৌথ কৌশলগত ফোরাম গঠনের উদ্যোগ এবং আমেরিকার বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষায় একটি চুক্তি চূড়ান্ত করেছে।
এ দুই উদ্যোগের মাধ্যমে ভবিষ্যতে চীনের আমদানিকৃত জ্বালানির প্রধান সরবরাহ পথে নজরদারি ও বঙ্গোপসাগরে জ্বালানি ব্যবসায়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে চায় আমেরিকা।
আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘কৌশলগত সংলাপ ফোরাম’ গঠনের লক্ষ্যে একটি যৌথ দলিল চূড়ান্ত করেছে দুই দেশ। বৃহস্পতিবার সাংবাদিক সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি জানান, হিলারি ক্লিনটনের আসন্ন ঢাকা সফরে এটি স্বাক্ষরিত হবে। তবে বাংলাদেশে আমেরিকার বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষায় টিফা’র আদলে প্রণীত ‘বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহযোগিতা রুপরেখা চুক্তি’ বা টিকফা স্বাক্ষরের বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাননি দীপু মনি। তবে তিনি বলেন, চুক্তিটি স্বাক্ষরের সম্ভাবনা তিনি নাকচ করে দিচ্ছেন না।
হিলারি ক্লিনটনের এ সফর বর্তমান সরকারের জন্য দীর্ঘ প্রতিক্ষীত ছিল। বিএনপির গত মেয়াদ থেকে আমেরিকার সঙ্গে শুরু হওয়া ক্রমবর্ধমান কৌশলগত সম্পর্কের আভাস বাস্তবে রুপ দিতে আগ্রহী বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার এক্ষেত্রে দুটি ক্ষেত্রে বাধার মুখে পড়ে। একদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে সরিয়ে দেয়া, অন্যদিকে পদ্মা সেতু প্রকল্পে যোগাযোগমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগ। এই নিয়ে দৃশ্যত দুই দেশের মধ্যে নানা কথা চালাচালি দেখা গেলেও হিলারির সফরের প্রস্তুতি থেমে থাকেনি।
বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষার চুক্তি কৌশলগত অংশীদারিত্বের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পথে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ও সামরিক সংলাপ ও প্রস্তুতি শেষে সফরে আসছেন আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে ২০০৩ এর জুন মাসে কলিন পাওয়েল হচ্ছেন দেশটির সর্বশেষ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যিনি বাংলাদেশ সফর করেন।
বঙ্গোপসাগরে নিজেকে ‘নিরাপদ’ দেখতে চায় আমেরিকা
গত ১৯ এপ্রিল প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ-আমেরিকা সামরিক অংশীদারিত্বের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে অনুষ্ঠিত সংলাপ শেষে এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে কিছুই জানানো হয়নি। তবে দেশটির সরকারি সূত্রের বরাত দিয়ে রাশিয়ার একটি সরকারি দৈনিকে প্রকাশিত বিবরণে দেখা গেছে, বঙ্গোপসাগরে নিজেদের স্বার্থের নিরাপত্তা বৃদ্ধিকেই সংলাপে বেশি জোর দিয়েছে আমেরিকা।
সংলাপে আমেরিকার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-সামরিক বিষয়াদির ব্যুরো’র (ব্যুরো অফ পলিটিকাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স) দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী সচিব অ্যান্ড্রু জে শ্যাপিরো। ব্যুরো ফর পলিটিকাল-মিলিটারি অ্যাফেয়ার্সের দায়িত্ব হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সামরিক ঘাঁটিসহ অন্যান্য সামরিক ও কৌশলগত স্থাপনা বসানো ও নানা ধরনে সেনা উপস্থিতির জন্য দরকারী রাজনৈতিক সমঝোতা করা।
প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মালাক্কা প্রণালী পেরিয়ে আরো উত্তরে- সেন্ট মার্টিন দ্বীপের কাছে মিয়ানমারের উপকূলে চীনের অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এমন পরিপ্রেক্ষিতে এ অঞ্চলে আমেরিকার উপস্থিতি বাড়াতে চাওয়া দেশটির পক্ষে সঙ্গত।
রাশিয়ার দৈনিক রুশিয়াস্কা গ্যাজেটা’র একটি সহযোগী প্রকাশনার প্রতিবেদনে জানা গেছে, বঙ্গোপসাগের ‘নিরাপদ’ অবস্থা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বিবেচনা করে আমেরিকা এবং সে অনুযায়ী কাজ করতে চায় দেশটি। এমন কথাই সামরিক সংলাপে শ্যাপিরো জানিয়েছেন বাংলাদেশকে।
শ্যাপিরো বাংলাদেশকে বলেন, ‘‘গত দশকে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সামরিক সম্পর্ক এশিয়ায় সবচেয়ে তেজিভাবের সম্পর্কগুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে উঠেছে। বঙ্গোপসাগরে নিরাপত্তা বজায় রাখতে বাংলাদেশ অন্যতম প্রধান কর্তা। … কূটনৈতিক সংশ্লিষ্টতার মধ্যে নিরাপত্তা সহযোগিতা কিভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার রাখতে পারে তার একটা প্রধান উদাহরণ হচ্ছে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সহযোগিতা।’’
বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নে সরকারি প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে আমেরিকার প্রতিনিধি বলেন এ প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে এমন সামরিক সরঞ্জামাদি দরকার হবে যা বাংলাদেশের সামর্থ্যের মধ্যে এবং সেই সরঞ্জাম সংগ্রহে অংশীদারও খুঁজে পেতে হবে বাংলাদেশকে।
আমেরিকাকে এমন অংশীদার উল্লেখ করে শ্যাপিরো বলেন, ‘‘এই আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা সম্প্রসারিত করার সুযোগ করে দিয়েছে, বিশেষ করে ‘অতিরিক্ত সামরিক সরঞ্জামাদি কর্মসূচি’র মাধ্যমে, যে কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা আমাদের দরকারের অতিরিক্ত সরঞ্জামাদি আমাদের অংশীদারের ব্যবহারের জন্য সুযোগ করে দেই।’’
অ্যান্ড্রু জে শ্যাপিরো বলেন, ‘‘সংক্ষেপে, আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’’
দীর্ঘ প্রস্তুতির সফর: অনেক আশা
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের সফরের দীর্ঘ প্রস্তুতিপর্ব শেষ হয় সামরিক সংলাপের মধ্য দিয়ে। এ বছরের শুরু থেকেই হিলারির সফর ও শান্তিতে নোবেলজয়ী বাংলাদেশী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে সর্ম্পকিত করে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে শীতলাবস্থার মুখরোচক খবরে অনেক সংবাদমাধ্যম মুখর থাকলেও বাস্তব পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন।
নানা ক্ষেত্রে নানা পর্যায়ের প্রস্তুতি চলেছে জানুয়ারির মাঝামাঝি থেকে। তার ধারাবাহিকতায় ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সফর করেন দেশটির সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। পরের মাসের ৫ তারিখে আসেন উপ-সহকারী প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড. জেমস এ শিয়ার। সহকারী সামরিক সংলাপের আগে সর্বশেষ ৪ এপ্রিল ঢাকায় আসেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিষয়াদি’র আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি আর শেরম্যান।
রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রসহ সামগ্রিক কৌশলগত ক্ষেত্রে অংশীদারিত্ব বাড়াতে যৌথ একটি ফোরাম গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয় সামরিক সংলাপে। সেই সংলাপের ওপর ভিত্তি করেই প্রণীত হয়েছে ‘বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশদারীত্ব সংলাপ’ শীর্ষ দলিলটি।
বৃহস্পতিবারের সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি এটাকে উল্লেখ করেন ‘সহযোগিতা সংলাপ’ নামে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এটি হবে বাংলাদেশ ও আমেরিকার মধ্যে বৃহত্তর সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের দিশারী দলিল। প্রস্তাবিত এই সংলাপ দুই স্তর বিশিষ্ট হবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব ও আমেরিকার পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে প্রথম স্তর গঠিত হবে। তারা বছরে একবার বৈঠকে বসবেন। এটি হবে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক। দ্বিতীয় স্তরে নেতৃত্বে থাকবেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এটি একটি অভিন্ন প্লাটফর্ম নিশ্চিত করবে, যা প্রতিবছর কোনো সময় দু’পক্ষের নিয়মিত বৈঠক নিশ্চিত করবে।
সমুদ্রে তেল-গ্যাসের লড়াই, বিনিয়োগের বিশেষ সুরক্ষা
বাংলাদেশের সঙ্গে এমন একটি যৌথ ফোরাম এ অঞ্চলে বিশেষত বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমার উপকূলে চীনের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও কৌশলগত উপস্থিতির বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিশাল অর্জন। সেন্টমার্টিন দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশের (আরাকান) রামরি দ্বীপ থেকে পাইপলাইন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে চীন। এতে করে মালাক্কা প্রণালী ঘুরে সমুদ্রপথে তেল পরিবহণের সময়-অর্থের বাড়তি খরচ থেকে বেঁচে যায় চীন। আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করা তেলের প্রায় পুরোটাই এ পথে দেশে নিতে চায় চীন। আর এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ পথে নিজেদের উপস্থিতি হাতছাড়া করতে চায় না যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের প্রধানতম জ্বালানি সরবরাহ পথে নিজেদের উপস্থিতি ছাড়াও খোদ বঙ্গোপসাগরের জ্বালানি ব্যবসায়ে নিজেদের বিনিয়োগের সুরক্ষা আদায়ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম এজেন্ডা।
কৌশলগত অংশীদারিত্বের চুক্তির পাশাপাশি এসফরের দ্বিতীয় প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে টিফা’র আদলে প্রণীত ‘বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ সহযোগিতা রুপরেখা চুক্তি’ বা টিকফা। অনেক বছর ধরে এমন একটি চুক্তির জন্য যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়ে আসছে। অনেক দরকষাকষির পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বৃহস্পতিবার জানালেন, চুক্তিটি স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত হয়েছে। এ সফরে চুক্তিটি স্বাক্ষরের সম্ভাবনার কথাও নাকচ করে দেননি তিনি। প্রায় দেড় দশকের আলোচনা শেষে অর্জিত হতে যাওয়া এ ‘টিফা’ চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর জন্য বিশেষ সুরক্ষা দেবে।
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের দুটি গ্যাস ব্লকে অনুসন্ধান চালাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি কনোকো ফিলিপস, এবং সাগরের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমানা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ায় এখানে আরো ছয়টি ব্লকে অনুসন্ধান চালানোর প্রস্তাব দিয়েছে কোম্পানিটি। এ বিশাল জ্বালানি ব্যবসায়ের সবচেয়ে বড় সম্ভাব্য প্রতিযোগী চীনের চেয়ে স্পষ্টতই এগিয়ে যাচ্ছে আমেরিকা। চীনের কোনো প্রস্তাবের কথা এখনো শোনা যায়নি, কিন্তু আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসছেন কাল।