অনন্য সাধারণ চোখ জুড়ানো অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পর্দা উঠলো লন্ডন অলিম্পিক গেমসের। গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ-এর যথাযথ গুরুত্ব ও মাহাত্ম ফুটিয়ে তুলতে কোন কার্পণ্য করেনি বৃটিশ আয়োজকরা। সাত বছরের প্রস্তুতি শেষে আধুনিক
অলিম্পিকের ত্রিশতম আসর উদ্বোধন করেন বৃটিশ রাণী দ্বিতীয় এলিজাবেথ। লন্ডনের অলিম্পিক স্টেডিয়ামে তিন ঘণ্টার চোখ ধাঁধানো নানা আয়োজন ছিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য বিকাল ৫টায় স্টেডিয়ামের গেট খুলে দেয়া হয়। ২৭ মিলিয়ন পাউন্ডের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন স্লামডগ মিলেনিয়ামখ্যাত চলচ্চিত্রকার ড্যানি বয়েল। গ্রিনিচ মান সময় ৮টা আর বৃটিশ সময় ৯টায় প্রায় ৬২,০০০ দর্শকের সামনে শুরু হয় অনুষ্ঠান। তবে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি দর্শক এ আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করেন টেলিভিশনের কল্যাণে। অলিম্পিক মশাল প্রজ্বলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয় দু’ সপ্তাহব্যাপী বিশ্ব ক্রীড়াযজ্ঞের। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বিশ্ববাসীকে লন্ডন অলিম্পিকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বক্তৃতা দেন।
এ নিয়ে লন্ডনে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সর্বাধিক তৃতীয় অলিম্পিক। এর আগে ১৯০৮ ও ১৯৪৮ সালে অলিম্পিক গেমস হয় ইংল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের এই রাজধানী শহরে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও নিখুঁতভাবে ‘টিউনিং’ করা একটি ঘণ্টার ধ্বনী দিয়ে শুরু হবে জাঁকজমকপূর্ণ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের।
বেইজিংকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া ড্যানি বয়েলের পরিচালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতে তুলে ধরা হয় যুক্তরাজ্যের গ্রামীণ ‘সবুজ ও সমাহিত’ পটভূমি। সত্যিকারের খামারের গবাদি পশুই ব্যবহার করেন বয়েল। ছিল সত্যিকারের গরু-ছাগলই।
সংগীত পরিচালনা করেছেন ইংল্যান্ডের ব্যান্ড ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’-এর বিখ্যাত জুটি রিক স্মিথ ও কার্ল হাইড। যুক্তরাজ্যের গর্ব সিক্রেট এজেন্ট ‘জেমস বন্ড’ও ছিলেন অনুষ্ঠানে। বর্তমান বন্ড ড্যানিয়েল ক্রেইগ অভিনীত একটি শর্ট ফিল্ম দেখানো হয় বিশাল পর্দায়। আর অনুষ্ঠানের শেষ প্রান্তে ছিল ‘বিটলস’ খ্যাত স্যার পল ম্যাককার্টনির গান। যুক্তরাজ্যে ভারতীয় প্রভাব বোঝাতে ছিল জনপ্রিয় সুরকার এ আর রহমানের সুর করা একটি পাঞ্জাবি গানও।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রাণীর স্বামী ‘ডিউক অব এডিনবার্গ’ প্রিন্স ফিলিপ এবং আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) সভাপতি জ্যাক রগের উপস্থিতিতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন লন্ডন অলিম্পিক আয়োজক কমিটির সভাপতি সেবাস্টিয়ান কো। এবারের অলিম্পিকে ২৬টি খেলায় ৩০২টি ইভেন্টে ২০৪টি দেশের প্রায় সাড়ে ১০ হাজার প্রতিযোগী অংশ নিচ্ছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বিশ্বের শতাধিক দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানরা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
আগের মতো এবারও ‘ওয়াইল্ড কার্ড’ নিয়ে অলিম্পিকে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ। শুটিংয়ে শারমিন আক্তার রত্না, আরচারিতে ইমদাদুল হক মিলন, সাঁতারে মাহফিজুর রহমান সাগর, অ্যাথলেটিক্সে মোহন খান ও জিমন্যাস্টিক্সে সাইক সিজার বাংলাদেশের পাঁচ প্রতিযোগী।
বৃটিশ সময় সকাল ৮টা ১২ মিনিটে গণঘণ্টা বাজানোর মধ্য দিয়ে গৌরবের দিনটি শুরু করে লন্ডনবাসীরা। রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা যাওয়ার পরে এই প্রথম ‘বিগ বেন’ বাজানো হয় তিন মিনিট ধরে।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠান রাতে হলেও দিনে লর্ডস ক্রিকেট মাঠে অনুষ্ঠিত হয় আরচারি। যেখানে বাংলাদেশের তীরন্দাজ ইমদাদুল হক মিলনও অংশ নেন। অতিরিক্ত টিকিট বিক্রির গুজবে দশর্করা হুমড়ি খেয়ে পড়ে লর্ডসে ঢোকার জন্য। লন্ডন ২০১২ ওয়েবসাইটে প্রাথমিক রাউন্ডের খেলাগুলোতে কোন টিকিট লাগবে না লেখা থাকায় জনসাধারণ মনে করেছিল এটি বুঝি সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। আসলে তা ছিল না। ফলে হুলস্থুল পড়ে যায় দর্শকদের মধ্যে। তবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের টিকিট পাওয়া গেছে গতকালও। দাম ছিল ১৬০০ ও ২০১২ পাউন্ড।
অলিম্পিক মশালের পরিভ্রমণ
সকাল ৭টায় হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস থেকে শেষ দিনের মতো অলিম্পিক মশালের যাত্রা শুরু হয়। রাণীর বিশেষ বার্জ গ্লোরিয়ানায় করে নৌপথে মশাল নিয়ে আসা হয় লন্ডনে। প্রায় ৫০টি ছোট নৌকার বহর ছিল মশাল শোভাযাত্রায়। দুপুর পৌনে একটায় মশাল টাওয়ার ব্রিজে পৌঁছে। কয়েক জায়গায় পরিভ্রমণ শেষে বিকালে তা পৌঁছে অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। সিটি হলে মশালটি রাখা হয় তখন। সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের আগে। অলিম্পিকের উদ্বোধনী দিনে পুরো লন্ডন ছিল সুরেলা। বিকাল চারটায় লন্ডনের কয়েকস্থানে কনসার্ট আয়োজন হয়। হাইড পার্কের মূল আয়োজনে গান পরিবেশন করে স্নো প্যাট্রল, স্টেরিওফোনিক্স, ডুরান ডুরান ও পাওলো নুটিনি। প্রায় ৮০০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অলিম্পিক মশাল আসে লন্ডনে। টাওয়ারের হ্যামলেটের ভিক্টোরিয়া পার্কেও নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় লন্ডনে রাণী ও ডিউক অব এডিনবরা বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশের প্রধানদের সম্মানে এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। বাকিংহাম প্যালেসের এ অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামাও উপস্থিত ছিলেন।