কাপাসিয়া সদর থেকে ১০ মাইল পূর্বের একটি ছোট্ট স্টেশন চালাবাজার। অনেকটা হঠাৎ করে এখানেই কৃষক-জনতার সমাবেশ আয়োজন করেছে বিএনপি। আজ বিকালে এ মাঠেই সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়া। নিখোঁজ ইলিয়াস ইস্যুতে কড়া আন্দোলনের পর এ সমাবেশের মাধ্যমে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা ঘটাতে চাইছে একটি বাঁকবদল। সরকারদলীয় স্থানীয় এমপি সোহেল তাজের পদত্যাগকে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে দলটি। সেজন্য বাঁকবদলের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে কাপাসিয়াকে। এদিকে সোহেল তাজের পদত্যাগ ও সরকারের আচরণ নিয়ে বিরক্ত কাপাসিয়াবাসী। বিগত এক যুগ ধরে এখানে কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। ফলে একদিকের উন্নয়ন বঞ্চনা, অন্যদিকে দ্বন্দ্ব-অনিশ্চয়তা। কাপাসিয়ার মোড়ে মোড়ে তাই আলাপে-আড্ডায় আলোচনার মুখ্য ইস্যু এটি। এমন পরিস্থিতিতে কাপাসিয়ায় খালেদা জিয়ার আগমন সাধারণ মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করেছে উৎসুক্য। কৌতূহলী রাজনৈতিক মহল। গতকাল কাপাসিয়া বাসস্ট্যান্ড, তরগাঁও হাসপাতাল মোড়, শ্যামপুর চৌরাস্তা ও ঘাঘটিয়া চালাবাজার ঘুরে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। শোনা গেছে, নানা মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া। ওদিকে চালাবাজার ঘাগটিয়া ওয়েলফেয়ার ক্লাব মাঠে চলছে জোর প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে মঞ্চ তৈরি ও সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে স্থানীয় বিএনপি। চলছে জোর প্রচারণা।
কি বলবেন খালেদা জিয়া
বিএনপি নেতারা জানান, কাপাসিয়ার মাধ্যমে ফের জনসম্পৃক্ততামূলক আন্দোলনে ফিরছে বিএনপি। এ সমাবেশে জনগণের ভোটের অধিকার রক্ষায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির যৌক্তিকতা তুলে ধরবেন খালেদা জিয়া। কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীকে অপহরণ ও বিএনপি’র হরতালসহ কঠোর আন্দোলনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করবেন। সরকারের আচরণ, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির চিত্র তুলে ধরে এ ব্যাপারে দেশী-বিদেশী মহলের উদ্বেগের কথা জানাবেন। কাপাসিয়ার সরকারদলীয় এমপি সোহেল তাজের পদত্যাগের ঘটনার মধ্যদিয়ে সরকারের সার্বিক ব্যর্থতা ও নানা ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের কথা তুলে ধরবেন। কাপাসিয়াবাসীকে জানাবেন বর্তমান সরকারের অনিয়ম, দুর্নীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ছেলেকেও পদত্যাগ এবং রাজনীতি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এ ঘটনার মাধ্যমে তিনি দেশবাসীকে সরকারের চরিত্র পর্যালোচনার অনুরোধ জানাবেন। কৃষিপ্রধান কাপাসিয়ার কৃষকদের সঙ্গে প্রশ্ন-উত্তরে বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়ন মূল্যায়ন করবেন। বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে কিভাবে দেশ পরিচালনা করবে, কোন কোন বিষয়কে প্রাধান্য দেবে তার একটি দিকনির্দেশনা জানাবেন দেশবাসীকে। সব মিলিয়ে আগামীতে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও সব দলের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পক্ষে জনমত সৃষ্টির জোর তাগিদ দেবেন।
সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ, উৎসুক
চলমান রাজনৈতিক পারিস্থিতি ও স্থানীয় এমপি সোহেল তাজের পদত্যাগ নিয়ে ক্ষুব্ধ উন্নয়নবঞ্চিত কাপাসিয়ার সাধারণ মানুষ। চায়ের দোকান থেকে ঘরোয়া আড্ডায় নিজেদের বিরক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার কাপাসিয়া সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উৎসুক্য লক্ষ করা গেছে তাদের মধ্যে। জুমার নামাজের পর তরগাঁও বাস স্টেশনের একটি চায়ের দোকানে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন বয়স্ক ব্যক্তি। আলাপের বিষয়বস্তু খালেদা জিয়ার কাপাসিয়া আগমন। সেখানে সিংহশ্রী ইউনিয়নের মোতালেব সরকার বলেন, সোহেল তাজ দুই বার এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। এর আগে তার চাচা আফসারউদ্দিন আহমেদ এমপি ছিলেন। তারা মন্ত্রী হয়েছেন কিন্তু মন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে পারেননি। এলাকায় কোন কাজ করতে পারেননি। মানুষ তাজউদ্দিন আহমদের আবেগের ওপর আর কতদিন মূূল্য দেবে। তিনি সরকারের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, সোহেল তাজকে নিয়ে সরকার যে আচরণ করেছে, তা দেশবাসী বুঝে। কাপাসিয়া থেকে চালারবাজার যাওয়ার পথে গাড়িতে কথা হলো কয়েকজন ছাত্রের সঙ্গে। তাদের মধ্যে খালেদা জিয়ার কাপাসিয়া সফর নিয়ে ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেল। এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেই আবদুল আলিম নামের একজন বললেন, এখানে জোর যার নীতি তার। গাজীপুর থেকে কাপাসিয়া রোডের বাস ভাড়া খুবই বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতারা সেসব নিয়ন্ত্রণ করায় কেউ কিছু বলতে পারে না। শ্যামপুর চৌরাস্তায় কৃষক আজিমুদ্দিন বলেন, সোহেল তাজকে এমপি বানিয়েছি। কিন্তু তিনি থাকেন আমেরিকায়। কাপাসিয়াবাসী সুখে-দুঃখে তাকে কাছে পায় না। এখন শুনছি তিনি পদত্যাগ করেছেন। কাজ করতে না পারলে পদত্যাগ করাই ভাল। সেখানে শালদৈ গ্রামের নাসিমুল ইসলাম বলেন, কাপাসিয়ার মানুষ আওয়ামী লীগ বোঝে না, বোঝে তাজউদ্দিন আহমদের পরিবার। সোহেল তাজ না থাকলে মানুষ চিন্তাভাবনা করবে। বিকালে ঘাঘটিয়া চালার বাজারে বিভিন্ন বয়সের বেশ কয়েকজন লোকের সঙ্গে আলাপ হলো। দেশের চলমান রাজনীতি, সরকারের মূল্যায়ন, সোহেল তাজের পদত্যাগ ও খালেদা জিয়ার কাপাসিয়া আগমনকে কেন্দ্র তাদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। মাঝিবাড়ি গ্রামের আসাদুজ্জামান বলেন, একটি পরিবর্তন দরকার। সোহেল তাজ সক্রিয় রাজনীতিতে না ফিরলে সে পরিবর্তন সময়ের ব্যাপার মাত্র। খিরাটির বশির আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রথমবার সোহেল তাজ বলেছিলেন বিরোধী দলে, তাই এলাকার কাজ করতে পারছেন না। এবার তো সরকারি দলে থেকেই কিছু করতে পারলেন না। জিরোৎফেরা গ্রামের আলী আকবর বলেন, প্রধানমন্ত্রী ও সোহেল তাজের পরিবারের মধ্যে একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে। তাদের মধ্যে মান-অভিমান ঘটতে পারে। কিন্তু কাপাসিয়াবাসী কি দোষ করেছে। বিগত এক যুগ ধরে এখানে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগের সমর্থন বেশি। কিন্তু এখন অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। আওয়ামী লীগেরই কয়েকটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে। কেউ চায় সোহেল তাজ রাজনীতিতে থাকুক, কেউ চায় সরে যাক।
উদ্দীপ্ত স্থানীয় বিএনপি
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার আগমনকে কেন্দ্র করে এখন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা স্থানীয় বিএনপি’র তৃণমূলে। গতকাল বিকালে সমাবেশস্থল ঘুরে দেখা গেছে, শত শত মানুষের ভিড় লেগেছে সেখানে। পাশের উপজেলা শ্রীপুর থেকে ৫০০ মোটর বাইকের শোভাযাত্রা নিয়ে সমাবেশস্থল ঘুরে গেছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। একইভাবে গাজীপুর, নরসিংদীর মনোহরদী, বেলাব ও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থেকে নেতাকর্মীরা জোর প্রস্তুতি নিয়েছেন সমাবেশকে সফল করতে। বিএনপি নেতারা বলছেন, খালেদা জিয়ার এ সফর কাপাসিয়ায় আওয়ামী লীগের দুর্গ ভেঙে দেবে। আশপাশের এলাকাগুলোয়ও বিএনপি’র সাংগঠনিক অবস্থান মজবুত হবে। যার প্রভাব পড়বে আগামী নির্বাচনে। এদিকে কাপাসিয়ায় খালেদা জিয়ার হঠাৎ সফর নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সমাবেশের উদ্যোক্তা ব্রি. জেনারেল (অব.) আসম হান্নান শাহ বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি দেশের প্রচলিত রাজনীতির ধারা থেকে বেরিয়ে এসে শান্তিপূর্ণ জনসম্পৃক্ততামূলক আন্দোলন শুরু করেছিল। সেখানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখে সরকার নেতিবাচক কৌশল নিয়েছে। আমাদের শান্তিপূর্ণ ‘ঢাকা চলো’ কর্মসূচিতে নজিরবিহীন বাধার সৃষ্টি ও রাজনৈতিক নেতাদের গুমের কৌশল নিয়েছে। তিনি বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে কৌশল পাল্টে ফের জনসম্পৃক্ততামূলক কর্মসূচি শুরু করেছে বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে তিন দিনের প্রস্তুতিতে তিনি কাপাসিয়ার একটি ইউনিয়নে জনসভায় অংশ নিচ্ছেন। হান্নান শাহ বলেন, আমরা সরকারকে দেখিয়ে দিতে চাই একটি গ্রামেও খালেদা জিয়ার ডাকে জনগণ কিভাবে ছুটে আসে। টার্গেটের কথা বলব না তবে লাখো জনতার সমাবেশ হবে। তিনি বলেন, কাপাসিয়াবাসী ও আশপাশের বিভিন্ন উপজেলার মানুষ খালেদা জিয়াকে একনজর দেখতে চান। সাধারণ মানুষের এ চাওয়াকে গুরুত্ব দিয়ে তিনি কাপাসিয়া আসছেন।